পর্ব—৪
হাকীমুল ইসলাম আল্লামা শাহ্ মুফতী আব্দুল হালীম বোখারী (রহ.) একজন অনন্য কলম সৈনিক ও আদর্শ লেখক ছিলেন। ১৯৮২ সাথে থেকে জামিয়ার মুখপাত্র ‘মাসিক আত-তাওহীদ’-এর প্রথমতঃ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি লেখালেখি করতেন। ছাত্রজীবনে লেখালেখির স্মৃতি চারণ করে বলেন, জামিয়া পটিয়ায় আমাদের অত্যন্ত দয়ালু এবং প্রিয় শিক্ষক ছিলেন মুফতি ইবরাহীম রহ.। তিনি নিরলস লেখালেখি করতেন আর আমাদেরকে লিখতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি ছাত্রদেরকে রচনাশৈলির প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। উর্দূ ভাষার প্রতি আমাদেরকে তিনিই উদ্বুদ্ধ করেছেন। আল-জামিয়া পটিয়ার কাফেলায় যখন তিনি শামিল হন, তখন থেকেই লেখালেখি, রচনাশৈলী ও শিক্ষকতার পদ্ধতির রঙ পাল্টে যায়। তাঁর দিক-নির্দেশনায় উর্দূ লেখার প্রতি একটা ঝোঁকের সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীকালে আমাদেরকে উন্নতির রাজপথে এনে দাঁড় করিয়েছে। তাঁর লেখালেখিও বয়ানের মতো স্পষ্ট ছিলো। পাঠ্যক্রমভুক্ত অনেক কিতাবের ব্যাখ্যা লিখেছেন। তাঁর গদ্য কি পদ্য, উভয়ই প্রাঞ্জল ছিলো। কবিতা ও কাব্যচর্চা খুব উপভোগ করতেন।
তাঁর লিখিত রচনাই প্রথম স্থান অধিকার করে তবে কেউ পুরস্কৃত হয়নি :
আল্লামা আব্দুল হালীম বোখারী (রহ.) নিজেই বলেছেন, ছাত্র যামানায় জামিয়া পটিয়ায় ‘কওমী মাদরাসার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা’ বিষয়ক একটি রচনা প্রতিযোগিতার ঘোষণা দেয়া হলো। যে কোন কারণে আমি সেখানে অংশ গ্রহণ করতে পারিনি। তখন আমার জুনিয়ার এক ছাত্র এসে বলল, ‘আমাকে একটি রচনা লিখে দিন’। আমি তাতে রাজি হয়ে যাই। ঐ বিষয়ে একটি রচনা লিখে দিই। আমার হাতের লেখা দেখে হুযূর ধরে পেলতে পারবেন। তাই ফাউন্টেন ফ্যান কলমকে উল্টো করে লিখেছি। যেন হুযূররা ধরতে না পারেন। অতঃপর ঐ ছাত্র রচনাটি তার নামে জমা দেয়। ফলাফলে সেই রচনাটি প্রথম স্থান অধিকার করল। যখন রচনায় প্রথম স্থানে ঐ ছাত্রের নাম দেখল, তখন সকলেই হতবাক হয়ে গেল। এই ছেলে কীভাবে এত সুন্দর রচনা লিখল?! অতঃপর খতীবে আজম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ (রহ.) ও মুফতি ইবরাহীম (রহ.) অনুসন্ধান চালিয়ে নিশ্চিত হন যে, এটি আমার লেখা ছিলো। তখন তাঁরা আমাকে ডেকে বলেন, ‘‘জ্ঞান কি বেচা-কেনা করা যায়?” তুমি কেন এই ছাত্রকে রচনা লিখে দিলে? আমি লজ্জিত হয়ে চুপ হয়ে গেলাম। তাই সেই প্রতিযোগিতায় আর কাউকেই পুরস্কৃত করা হয়নি।
আমরা থাকবো না, কিন্তু আমাদের রচনাসমগ্র পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে :
আল্লামা বোখারী রহ. বলেছেন, ছাত্র যামানায় আমি একবার মুফতি ইবরাহীম (রহ.)-এর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে গেলাম। দেখলাম, তিনি সেখানেও লেখালেখি করছেন। তখন আমি বললাম, হযরত, একদিনের জন্য বাড়িতে এসেছেন। এখানেও কি লেখালেখি করতে হয়? তখন হযরত রহ. বলেন, আমি তো পৃথিবী থেকে চলে যাবো, কিন্তু আমার এ রচনাসমগ্র পৃথিবীতে থাকবে। এ জন্য যথটুকু সম্ভব এর জন্য মেহনত চালিয়ে যেতে হবে।
কতইনা সুন্দর এই ব্যাখ্যাগ্রন্থ!
আল্লামা মুফতি আব্দুল হালীম বোখারী (রহ.) বলেন, আমরা মুফতী ইবরাহী (রহ.)-এর ব্যাখ্যাগ্রন্থের জন্য কবিতা লিখতাম। আমি যখন টাঙ্গাইল চলে যাই তখনও তিনি চিঠির মারফত নতুন ব্যাখ্যাগ্রন্থের সুসংবাদ শুনাতেন এবং কবিতা লিখতে বলতেন। ‘মুসাল্লামুসসুবূত’-এর একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেন “আত-তাকরীরুল মুনাজ্জম”। আমি এর জন্য একটি কবিতা লিখলাম। আর এর “তারেখী নাম”ঐতিহাসিক নাম বের করলাম وہ شرح منظم কিন্তু সেখানে সংখ্যা মেলাতে আরো ‘এক’ সংযুক্ত করতে হচ্ছে। অর্থাৎ আলিফ সংযুক্ত করতে হচ্ছে। আমি চিন্তা-ফিকর করছি। এমন সময় হযরতের আরেক শিষ্য মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব তাশরীফ আনলেন। তিনি আমাদের নিকটে এক মসজিদে ইমামতী করতেন। তিনিও কবি ছিলেন। তিনিও হযরতের জন্য কবিতা লিখতেন। তাকে বললাম তারেখী নামে ‘এক’ সংযুক্ত করতে হচ্ছে। তখন তিনি বলেন, وہ شرح منظمএর পরিবর্তে واہ شرح منظم বললে তো মিলে যাবে এবং অর্থও সুন্দর হয়ে যায়। অর্থ হবে, কতইনা সুন্দর এই ব্যাখ্যাগ্রন্থ!
তাঁর লিখিত গ্রন্থাবলি:
আল্লামা আব্দুল হালীম বোখারী (রহ.) প্রতিটি দরসের নোট নিজ হাতেই তৈরী করেছিলেন। পরবর্তীতে পাঠ্যক্রমভুক্ত অনেক কিতাবের ব্যাখ্যা লিখেছেন। এ সব ব্যাখ্যাগ্রন্থ হতে ছাত্র-শিক্ষক সমানভাবে উপকৃত হয়ে থাকে। নিম্নে তাঁর কয়েকটি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হলো। (১) তাসহিলুত তাহাবী [তাহাবী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ] (২) তাসহীলুত তিরমিজী [তিরমিযী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ] (৩) তাসহিলুল উসূল [যা দরসের অর্ন্তভুক্ত]
পরিশেষে দুআ করি, আল্লাহ তাঁর খেদমাত কবুল করুন, তাঁর পাঠদান ও লেখালেখিসহ সকল উম্মতের জন্য উপকারী বানান এবং আমাদেরকে তাঁর আদর্শে আদর্শবান হওয়ার তাওফীক দান করুন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের উঁচু মাকাম দান করুন, আমীন।
লেখক : শিক্ষক, আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া।
Leave a Reply