শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৩:৫২ পূর্বাহ্ন

শুভ কর্মপথে ধর নির্ভর গান

শুভ কর্মপথে ধর নির্ভর গান

প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন । নাসিমুন আরা হক (মিনু)

শুভ কর্মপথে ধর নির্ভর গান

আজ ২৮ সেপ্টেম্বর, শেখ হাসিনার জন্মদিন। কোটি মানুষের মত আমারও আনন্দের দিন। আমার জন্য আজকের দিনটি একটি বিশেষ দিন। কারণ আজ থেকে ৬২ বছর আগে তাঁর সঙ্গে আমার আজিমপুর স্কুলে (বর্তমানে আজিমপুর গভমেন্ট গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ) প্রথম দেখা। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব, যা আজও অটুট রয়েছে। জীবন সায়হ্নে এসে অতীতের দিকে ফিরে তাকালে স্মৃতি বিজড়িত সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। বয়স যত বাড়তে থাকে ছেলেবেলার স্মৃতি তত মনে ভিড় করে। সেই স্মৃতির সঙ্গে ভিড় করে আমার আজিমপুর স্কুল ও স্কুলের বন্ধুদের স্মৃতি। আমরা আজিমপুর গভর্নমেন্ট স্টাফ কোয়ার্টারে আসি ১৯৫৮ সালে। তারপরই আমি আজিমপুর স্কুলে ক্লাস ফোরে ভর্তি হই।

স্কুল কাছে হওয়ায় আমরা কখনও দলবেঁধে, কখনও একা হেঁটেই স্কুলে চলে যেতাম। স্কুলের সামনে বিশাল মাঠ। সেটা ছিল আমাদের প্রধান আকর্ষণ। অবশ্য আজিমপুরে সব বাড়ির সামনেই ছিল বড়ো বড়ো মাঠ। বন্ধুরা তখন যেমন ছিল তেমনি এখনও আমাকে ভীষণ টানে। আজকাল স্কুলের বন্ধুদের কোনো পুনর্মিলনী থাকলে সব প্রোগ্রাম বাদ দিয়ে হাজির হয়ে যাই। কখনও মিস করি না। আমাদের বন্ধুদের অধিকাংশই নিজের নিজের পেশায় খুব সফল হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে সফল, সার্থক হয়েছেন শেখ হাসিনা। হ্যাঁ, আমি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা বলছি। শেখ হাসিনা আজিমপুর গার্লস হাইস্কুলে আসেন সম্ভবত ক্লাস সিক্সে। তার আগে ছিল নারী শিক্ষা মন্দিরে। স্কুলের দিনগুলো আমাদের কেটেছে পড়াশোনার পাশাপাশি গল্পের বই পড়ে, আড্ডা দিয়ে আর দুষ্টুমি করে। হাসিনা সে-সময় অনেক দুরন্ত ছিলেন। টিফিনের সময় স্কুলের মাঠে বসে দল বেঁধে আড্ডা দেওয়া ছিল আমাদের কাজ। আমার মনে পড়ে ’৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ডাকে আমরা একদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে মিছিলে চলে গিয়েছিলাম।

সামরিক শাসক আইয়ুব খান দেশে মৌলিক গণতন্ত্র চালু করেছিল। আমাদের ‘সমাজপাঠ’ নামে একটি বইতে এসব পড়তে হতো। ক্লাস নাইনে সমাজপাঠ পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর লিখতে গিয়ে হাসিনা ‘মৌলিক গণতন্ত্রে’র কঠোর সমালোচনা করে অনেক কিছু লিখে দিয়েছিলেন। হাসিনা যে খুবই দৃঢ়চেতা ছিলেন এ তারই প্রমাণ। স্কুল থেকে খবর পেয়ে পরে তার গৃহশিক্ষককে এসে স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছিল। স্কুলের আরও স্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে, ’৬৪ সালে আমাদের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল স্কুলে ধর্মঘট করানোর ও পিকেটিং করার। ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলনের স্মরণে ঐ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল। আমরা স্কুলের সামনে পিকেটিং করেছিলাম। ছাত্রীদের বলেছিলাম আজ স্কুলে ধর্মঘট, তোমরা ফিরে যাও। ছাত্রীরা অবশ্য আমাদের কথা শোনেনি। আমরা সফল হইনি। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টা ভালোভাবে নেয়নি। শেখ হাসিনা, আমি নাসিমুন আরা হক (মিনু), সুলতানা কামাল (লুলু), কাজল, হোসনে আরা বেগম (হেলেন)-সহ আমাদের মোট ১০ জনকে স্কুল কর্তৃপক্ষ শোকজ করেছিল। বাকিদের সকলের নাম এখন আর মনে নেই।

১৯৬৫ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফর্ম পূরণ ইত্যাদি কাজে একদিন স্কুলে গিয়েছি। সে-সময় হাসিনা হঠাৎ বললেন, চল সবাই আমাদের বাড়িতে যাই। ওর ভেতরে এমন স্বতঃস্ফূর্ততা ও আন্তরিকতা ছিল। আমরা সাতজন হাসি, বেবী, হেলেন, বুড়ি, মর্জিনা ও আমি হাসিনার সঙ্গে ওদের বাড়ি গেলাম, ৩২ নম্বরে। দুপুরে সেখানে ভাত খেলাম। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আমাদের পরিবেশন করে খাওয়ালেন। শেখ রাসেল তখন ছোট্ট শিশু। বিছানায় শোয়া ছিল। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, পরে ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেগম মুজিব ও শিশু রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল দুর্বৃত্তরা। সেদিন আমরা অনেক আড্ডা দিলাম, ছাদে ও বাগানে বেড়ালাম। ছাদে হাসিনা ওর কাকার ক্যামেরায় আমাদের ছবি তুললেন। সে ছবি আমার কাছে এখনও আছে। এসএসসির পর আমাদের স্কুল পর্ব শেষ হলো। আমরা ভর্তি হলাম বকশীবাজারে গভ. ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজে (বর্তমান বদরুন্নেসা কলেজ)। এখানে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলো। আমি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। আমরা পুরোপুরি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়লাম।

তখন ছিল আইউব-বিরোধী তথা সামরিক শাসনবিরোধী উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের সময়। আমি কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাধারণ সম্পাদক (১৯৬৫-৬৬) নির্বাচিত হই। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ছাত্রলীগের সাঈদা গাফফার। তখন কলেজ ছাত্র ইউনিয়ন খুবই শক্তিশালী ছিল। আমাদের সময়ে আমরা কলেজে শহিদ মিনার নির্মাণ করেছিলাম। প্রিন্সিপাল তা পরের দিন ভেঙে দিয়েছিলেন। পরের বছর ১৯৬৬ সাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬-দফা ঘোষণা করেছেন। ৬-দফার পক্ষে সারাদেশে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কলেজ ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে সহ-সভানেত্রী পদে শেখ হাসিনা নির্বাচন করেন ও বিপুল ভোটে জয়ী হন। হাসিনা ছিলেন অত্যন্ত মিশুক স্বভাবের এবং অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আমাদের শামসুন্নাহার। আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধুরা অনেকেই শেখ হাসিনাকে ভোট দিয়েছিল। শেখ হাসিনা দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সঙ্গে সহ-সভানেত্রী হিসেবে ছাত্রী সংসদের কার্যক্রম পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো ছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের জন্য ছাত্রদের সংগ্রামে মুখর। বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের লড়াইয়ে উত্তাল। প্রতিদিন ছিল সংগ্রাম ও মিছিলের কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সমবেত হয়ে সেসব মিছিল শুরু হতো। কলেজ থেকে হেঁটে গিয়ে আমরা মধুর ক্যান্টিনে সভা-সমাবেশে বা শহিদ মিনারের মিছিলে যোগ দিতাম। সেই উত্তাল দিনগুলোতে এসব মিছিলে
আমরা একসঙ্গে অনেক হেঁটেছি। আমরা ছিলাম মিছিলের সহযাত্রী। এই সংগ্রামই পরে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। তখন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তার রেশ ধরে ’৭০-এর নির্বাচন এবং পরে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ।

১৯৬৮ সালে হঠাৎ করেই শেখ হাসিনার বিয়ে হয়ে যায় পরমাণু বিঙ্গানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সাথে। শুরু হলো তাঁর নতুন জীবন। ১৯৭১ সালের ২৭ শে জুলাই শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় জন্মগ্রহণ করেন। ৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্মাতক সম্পন্ন করেন তিনি। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ শাখার সদস্য এবং রোকেয়া হল ছাত্রলীগ ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ৭৫ এর ১৫ আগস্টে তিনি এবং শেখ রেহেনা পশ্চিম জার্মানিতে স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থলে অবস্থান করায় ঘাতকের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান।
১৯৭৫-’৮১ সাল পর্যন্ত তৎকালীন স্বৈরাশাসক তাঁর দেশে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা জারি করায় দীর্ঘ ৬ বছর বিদেশে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য হন। ’৮১ সালে দেশে না থেকেও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং একই বছর ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। শুরু করেন মানুষের অধিকার আাদায়ের সংগ্রাম। দীর্ঘ সংগ্রামের পরে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে। সেই বছরের নভেম্বরে দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত এবং বহু কাঙ্খিত গঙ্গা-পদ্মা নদীর ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি করেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৭ সালে তাঁরই হাত ধরে আসে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি। ২০০৪ সালে ২১শে আগস্ট তাঁর উপর নজীরবিহীন গ্রেনেড হামলা হয়। অল্পের জন্য প্রণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। ২০০৭ সালে তথাকথিত তত্ত্ববধায়ক সরকারের মিথ্যা দুর্নিতির মামলায় তাঁকে প্রায় ১ বছর জেলে আটকে রাখা হয়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বচনে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে পুণরায় ক্ষমতায় আসে।

২০১১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ভারত-বাংলাদেশের ৬৪ বছরের সীমান্ত সমস্যা সমাধান করে চুক্তি স্বাক্ষর করেন তিনি। তাঁর সরকারের আমলেই জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার, জেল হত্যার বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে। এসব বিচারের রায়ও কার্যকর করা হয়েছে। করোনা অতিমারি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মোকাবিলা করে তিনি দেশে-বিদেশে প্রসংশিত হয়েছেন। বিশ্ব ব্যাংকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু তৈরি করেছেন। দেশের সর্বত্র উন্নয়নের ছোঁয়া। তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। স্কুল জীবন থেকেই দেখেছি তাঁকে মানুষকে নিয়ে ভাবতে। মানুষের অধিকার, তাদের জীবনমান উন্নয়ন, দেশের উন্নয়ন এসবই ছিলো সবসময় তাঁর ভাবনায়।

আজকের এই দিনে আমি সকলের সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। শুভ জন্মদিন, শেখ হাসিনা। সুস্হ্য থাকুন, দীর্ঘজীবী হোন, দেশের উন্নয়নে, মানুষের কল্যাণে আমৃত্যু নিবেদিত প্রাণ হয়ে জনগণের মাঝে বেঁচে থাকুন, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে এই প্রার্থনা। পিআইডি নিবন্ধ

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র এবং নারীনেত্রী

শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved 2018 shilonbangla.com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com