রবিবার, ২৮ মে ২০২৩, ০৫:৪২ অপরাহ্ন

মানসিক উত্তেজনা-দুশ্চিন্তা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি

মানসিক উত্তেজনা-দুশ্চিন্তা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি

২৯ বিশ্ব হার্ট দিবস

মানসিক উত্তেজনা-দুশ্চিন্তা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি

মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস ২০২২। বিশ্বজুড়ে হৃদরোগ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশসহ বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়। স্বাস্থ্যবিষয়ক দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম দিন হলো- বিশ্ব হার্ট দিবস। হৃদরোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের বৃহত্তম একটি দিন এটি।প্রথম বিশ্ব হার্ট দিবসটি পালন করা হয় ২০০০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এবং ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবার বিশ্ব হার্ট দিবস হিসেবে পালন করা হত। পরে ২০১১ সাল থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর দিনটি বিশ্ব হার্ট দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়। বর্তমানে হৃদরোগ বিশ্বের এক নম্বর ঘাতক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্বের ১৯৪টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করবে। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না যে, বিশ্বের এক নম্বর মরণব্যাধি হচ্ছে হৃদরোগ। কোনো রকম পূর্বাভাস ছাড়াই হৃদরোগ যেকোনো সময় কেড়ে নেয় জীবন। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১ কোটি ৮৬ লাখ মানুষ কার্ডিওভাসকুলার রোগে মৃত্যুবরণ করে। বিশ্বজুড়ে ৫২ কোটি হৃদ্রোগী আছে। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক রোগে ৩ কোটির বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বির আধিক্য, সিগারেট ও তামাক-জাতীয় দ্রব্য, স্থূলতা, কায়িক পরিশ্রমহীনতা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসসহ বিভিন্ন কারণে হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ে। যার বেশির ভাগই নি¤œ ও মধ্যবিত্ত। একবার হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলে প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কিন্তু হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীকে সময়মতো হাসপাতালে স্থানান্তর করতে পারলে আধুনিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে সুস্থ করা সম্ভব। কিন্তু পূর্বে হৃদরোগ শনাক্ত করা না গেলে অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসা দেয়ার পূর্বেই রোগীর মৃত্যু ঘটে। তাই প্রতিরোধটাই সবচেয়ে জরুরি।

এ পরিস্থিতিতে রোগের ভয়াবহতা কমাতে উন্নত চিকিৎসার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, বাংলাদেশের মানুষও এই ঝুঁকিতে রয়েছে। উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত তরুণ ও যুবকরা হৃদরোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। সুস্থভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেউ, কোনো সমস্যা নেই, একদিন হঠাৎ শোনা যায় তাঁর ‘ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক’ হয়ে গেছে। সমস্যা হলো এমন ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগে প্রায়ই কিছু জানা যায় না। এ রকম হার্ট অ্যাটাকের পরিণতি হয় সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু, নয়তো জীবনের সঙ্গে আপস করে কোনোমতে চলা। তাই হৃদ্রোগ হওয়ার আগেই সাবধান হতে হবে।

কীভাবে বুঝবেন আপনি ঝুঁকিতে আছেন : কোনো সমস্যা বোধ করছেন না, বুকে ব্যথা করে না কখনো, অনেক পরিশ্রমও করতে পারেন, তার মানে কোনো দিন হার্ট অ্যাটাক হবে না—এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে ঝুঁকি কতটুকু আছে, তা জেনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে অকালমৃত্যু বা কঠিন পরিণতি এড়ানো যায়।নিজের ঝুঁকি জানতে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে আপনি আপনার ঝুঁকির মাত্রা জানতে পারেন। প্রশ্নের বেশির ভাগ উত্তরই যদি ‘হ্যাঁ’ হয়ে থাকে, তবে আপনার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেক বেশি। আপনি কি ধূমপান করেন? আপনার পরিবারে কি হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস বা অল্প বয়সে হঠাৎ মৃত্যুর ইতিহাস আছে? আপনার কি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বির মাত্রা বেশি আছে? আপনি কি কায়িক শ্রমবিহীন জীবন যাপন করেন? আপনি কি স্থূল বা আপনার কি ওজন বেশি? আপনার মানসিক চাপ কি প্রচণ্ড।

হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক লক্ষণ : বেশির ভাগ সময় হার্ট অ্যাটাকে বুকের মধ্যে চাপ বোধ হয়, যা কয়েক মিনিটের বেশি সময় ধরে থাকে। ব্যথাটা মাঝেমধ্যে চলে যায়, আবার ফিরে আসে। একটা অস্বস্তিকর চাপ ও ঝাঁকুনি অনুভূত হয়। অনেক সময় বাহু, পিঠ, ঘাড়, চোয়াল অথবা পাকস্থলীতেও অস্বস্তি অনুভূত হয়।
অনেক সময় বুকে অস্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে শ্বাস ছোট হয়ে আসে। অন্য লক্ষণগুলোর মধ্যে ঘাম দিয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব বা হালকা মাথাব্যথা, পিঠে বা চোয়ালে ব্যথা হতে পারে। হৃদরোগের কারনঃহৃদরোগের জন্য অনেক কারন দায়ী। যেমন- বয়স, লিঙ্গ, ধূমপান, অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ, পারিবারিক ইতিহাস, স্থূলতা, স্বল্প শারীরিক পরিশ্রম, খাবার দাবারে অসচেতনতা, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ লিপিড, ডায়াবেটিস ইত্যাদি। জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন, নিয়মিত হাঁটা বা শারীরিক পরিশ্রম, খাবার দাবারে একটু সচেতন হলে এবং ঊচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ লিপিড, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটা হ্রাস করা যেতে পারে।

কোন বয়সে হতে পারে?হৃদরোগ সব বয়সেই হতে পারে। তবে সাধারনত বয়স্ক ব্যক্তিরাই এ রোগের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারনভাবে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সিরাম কোলেস্টেরলের মাত্রাও বাড়ে। ৬৫ বছরের বেশি বয়সী হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৮২ শতাংশই হৃদরোগে মারা যায়। আবার ৫৫ বছর বয়সের পরে স্ট্রোক করার সম্ভাবনাও দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আবার বয়সের সাথে সাথে ধমনীর স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়, ফলে করোনারি ধমনী রোগ হয়।
কাদের হতে পারে? প্রজননে সক্ষম নারীর তুলনায় পুরুষদের হৃদরোগ হবার ঝুঁকি বেশি। প্রজননের সময়ের পরে, নারী ও পুরুষের হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা সমান। যদি কোন নারীর ডায়াবেটিস থাকে, তার হৃদরোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত পুরুষের চেয়ে বেশি। মধ্যবয়সী মানুষের ক্ষেত্রে, করোনারি হৃদরোগে আক্রান্তের সম্ভাবনা নারীদের তুলনায় পুরুষদের প্রায় ৫ গুণ বেশি। হৃদরোগে লিঙ্গ বৈষম্যের কারণ মূলত হরমোনগত পার্থক্য।

হৃদরোগের লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ : বুক, পিঠ, পেট, গলা, বাম বাহুতে ব্যাথা, ঘাড় বা চোয়ালে ব্যথা এবং অস্বস্তি অনুভুত হতে পারে। শ্বাসকষ্ট পাকস্থলির উপররের দিকে অসহনীয় ব্যাথা অনুভূত হবে। মাথা হালকা লাগতে পারে।

হৃদরোগ প্রতিরোধে করণীয় : হৃদরোগ নানান রকমের হতে পারে, যেমন- জন্মগত হৃদরোগ, বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ জনিত হৃদরোগ, হৃদপি-ে স্বল্প রক্ত চলাচলজনিত হৃদরোগ, হৃদপি-ে মাংসের দুর্বলতাজনিত হৃদরোগ ইত্যাদি। হৃদরোগ প্রতিরোধে সতর্ক হলে অনেক ভাল ফল পাওয়া যায়। নিম্নে জন্মগত হৃদরোগ এবং অন্যান্য হৃদরোগ প্রতিরোধে করনীয় বিষয় সম্মন্ধে বর্ণনা করা হল-

জন্মগত হৃদরোগ প্রতিরোধে করণীয় : গর্ভধারণের কমপক্ষে তিন মাস আগে মাকে MMR Injection দিতে হবে, গর্ভবতী মায়ের উচ্চরক্তচাপ বা ডায়াবেটিস থাকলে অবশ্যই চিকিৎসা করতে হবে।ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে সেটা অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে।গর্ভবতী অবস্থায় যেকোনো রকম ওষুধ খাওয়ার পূর্বে অবশ্যই অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

অন্যান্য হৃদরোগ প্রতিরোধে করণীয় : কম বয়সী ছেলে বা মেয়ের গলাব্যথাসহ জ্বর হলে, তাকে এক সপ্তাহের জন্য বেলাডোনা দিয়ে চিকিৎসা করলে ভবিষ্যতে হৃদরোগ হওয়ার আশংকা অনেকটা হ্রাস পাবে। আবার স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের মাধ্যমেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো যায়। হৃদপি-ে রক্ত চলাচলজনিত কারণে হার্ট অ্যাটাকের মত মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। এই সমস্যা প্রতিরোধে খাবার এবং জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন-প্রতিদিন কমপক্ষে একটি নির্দিষ্ট সময় হাঁটা বা ব্যায়াম অথবা শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। এটা হৃদরোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর।প্রচুর পরিমানে ফলমুুুল, শাকসবজি, তরকারি, টক জাতীয় ফল খেতে হবে। অপরদিকে লবণ ও চিনি কম খেতে হবে।বেশি ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার বর্জন করতে হবে।মদ্যপান, জর্দা, তামাক, ধূমপান ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে। ধূূূমপান ছাড়ার পরবর্তী ১০ বছর সময় পর্যন্ত হৃদরোগের ঝুঁকি থেকে যায়।ফাস্টফুড, টিনজাত ও শুকনো খাবার খাওয়া কমাতে হবে।অতিরিক্ত পরিমানে চা, কফি এবং কোমলপানীয় বর্জন করতে হবে।ধূমপান, অ্যালকোহল বা যেকোন ধরনের মাদক বর্জন করতে হবে।মহিলাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি এবং কিছু কিছু ওষুধ হৃদরোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।শরীরে চর্বি জমতে দেয়া যাবে না। এটা হৃদরোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ৪০ বছরের বেশি বয়সিদের ক্ষেত্রে, সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। প্রাণিজ চর্বি খাওয়া যাবে না, তবে উদ্ভিদ তেল খেতে হবে যেমন- সয়াবিন, সূর্যমুখী, সরিষার তেল ইত্যাদি। সামুদ্রিক মাছ খেতে হবে। বাদাম হৃদরোগের জন্য উপকারী। বাদামের ভেষজ প্রোটিন, ফলিক এসিড, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফ্লাভোনয়েডস, সেলিনিয়াম ও ভিটামিন-ই হৃদরোগের জন্য অত্যন্ত উপকারী।দাম্পত্য জীবনে সুখী থাকার চেষ্টা করতে হবে এবং ধর্মকর্মে মনোযোগী হতে হবে।মানসিক চাপ অর্থাৎ অনিদ্রা, টেনশন, ভয়, ক্রোধ, হতাশা, রাগ, প্রতিশোধ প্রবণতা, হিংসা ইত্যাদি বর্জন করতে হবে।উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থাকলে তা নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে। কমপক্ষে সপ্তাহে এক দিন রক্তচাপ পরীক্ষা এবং মাসে একবার করে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে।

হোমিওসমাধান : রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয় এই জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক কে ডা.হানেমানের নির্দেশিত হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি অনুসারে হৃদরোগ চিকিৎসা সহ যে কোন জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ভিওিক লক্ষণ সমষ্টি নির্ভর ও ধাতুগত ভাবে চিকিৎসা দিলে আল্লাহর রহমতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতিতে সম্ভব।

হোমিওরেমিডি : অভিজ্ঞ চিকিৎসক গন প্রাথমিক বাবে যে সব ঔষধ নির্বাচন করে থাকে, ক্র্যাটিগাস, অরম মেটালি কাম, এডডোনিস ভাণ্যালিস, অর্জুন, আর্নিকা মন্টেনা, গ্লোনয়িন,ভ্যানাডিয়ম, ল্যাকেসিস, ডিজিটালিস, বেলাডোনা, স্পাজিলিয়া, এনথেলমিয়া, ন্যাজাট্রাইপুডিয়ামস, নাক্স ভূমিকাসহ আরো অনেক ঔষধ লক্ষণের উপর আসতে পারে, তাই ঔষধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা,জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
drmazed96@gmail.com

শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved 2018 shilonbangla.com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com