মাসউদুল কাদির
প্রিয় উস্তাদ মাওলানা হারুনুর রশিদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি চিরদিনের জন্য পরপারে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে পাড়ি জমালেন। হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার খড়কী কাসেমুল ইলূম মাদরাসায় ছাত্র গড়ার পেছনে তিনি তাঁর মূল্যবান জীবন ব্যয় করেছেন। হাজারও তালেবুল ইলম তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের আঁখিতারা গ্রামে। মৃত্যুকালে তিনি প্রায় শত বছরের জীবন পেয়েছেন। পাকিস্তানের ইউসুফ বানূরী রহ.-এ শাগেরদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য লড়াইয়ে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। দৈনিক যুগান্তরে একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন করেছি। মিছিল করেছি। স্লোগান ধরেছি, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমীনের কল্লা চাই।
যাক, আমার বাড়ির খুব কাছে এ মাদরাসাটি। আমাদের সময়কার প্রায় সবাই এ মাদরাসায় পড়েছে। তারা হুজুরের কাছেও পড়েছে। খড়কী এলাকার সঙ্গে তিনি এমনভাবে মিশে গিয়েছিলেন যা বলাবাহুল্য।
গ্রামের নারী-পুরুষ-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই হুজুরকে পছন্দ করতেন। ভালোবাসতেন। এমন ভালোবাসা কুড়িয়েছেন দ্বিতীয় আর কোনো আলেমকে আমি দেখিনি।
সত্যটা হলো, আমার জীবনের প্রথম পড়ালেখার হাতেখড়ি এই হুজুরের কাছে। মাওলানা হারুনুর রশিদ রহ. একজন প্রচার বিমুখ আলেম ছিলেন। নিজেকে কখনও মেলে ধরতে চাইতেন না। তিলে তিলে কীভাবে একটা প্রতিষ্ঠান গড়তে হয়, শিক্ষার্থীদের কীভাবে বিনির্মাণ করতে হয় তার নজীর ছিলেন এই আলেম।
তিনি বরাবরই ঢাকার বা ফেমাস অনেক আলেমদের ব্যবহার নিয়ে নিজের কষ্টের কথা শেয়ার করতেন। বিশেষত, মাহফিল উপলক্ষে বক্তা আলেমদের বিশেষ ব্যবহার তিনি নিতে পারতেন না। মুবাল্লিগানা সিফত তালাশ করতেন। যা এখন বিরল বলে পাওয়া যায় না।
নিরলসভাবে নিজের পরিশ্রম ও সাধনায় খড়কী গ্রামের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে তিনি অবদান রেখে গেছেন। তার অবদান অস্বীকার করার জো নেই। সহনশীলতার পাহাড় ছিলেন তিনি। পঞ্চাশ বছরের উপরে একটি প্রতিষ্ঠানে সময় দেয়াটা কত জনের ভাগ্যে জুটে। সেটা আঁখিতারার এ ফুল খড়কীতে এসে জীবন ঢেলে দিয়ে দেখিয়ে গেছেন। এ দেশের মানুষ কখনও তাকে ভুলতে পারবেন না। তিনি আমাদের এলাকায় বড় হুজুর ও সরাইলের হুজুর হিসেবে খ্যাত ছিলেন।
মহান আল্লাহ তাআলা তাকে তুলে নিয়েছেন। মূলত আলেমদের তুলে নেয়ার মাধ্যমেই ইলম তুলে নেয়া হবে। এটা সত্য। হাদিসেও এ কথা স্পষ্ট।
রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন : ‘আল্লাহতায়ালা হঠাৎ করে এই ইলম বান্দাদের থেকে ছিনিয়ে নেবেন না; বরং উলামাদের ওঠানোর দ্বারা ইলম উঠিয়ে নেবেন। এক পর্যায়ে যখন কোনো আলেম থাকবে না, তখন মানুষ মূর্খ লোকদের নেতা বানিয়ে নেবে। তারা না জেনে ইসলামের বিধি-বিধান বর্ণনা করবে। ফলে নিজেরাও গোমরাহ হবে। অন্যদেরও গোমরাহ করবে। (বোখারি)।
মহান আল্লাহর কাছে বিশেষ প্রার্থনা, দিনশেষে আমরা সবাই তাঁরই কাছে ফিরে যাবো। আমাদের প্রিয় উস্তাদের জান্নাতে সুউচ্চ মাকাম দান করুন। হাজারও আলেমের উস্তাদ ছিলেন তিনি। আজ হয়তো দোয়া বর্ষণ হচ্ছে সবার তরফ থেকে। আমি অধমও তাদের সঙ্গে শরীক হলাম। রাব্বুল আলামিন তাঁকে ক্ষমা করুন। জান্নাতবাসী বানান।
মাওলানা হারুনুর রশিদ রহ. আমার বাবা হাজী আমির হোসাইন রহ.-এর জানাযার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, মাদরাসা নিয়ে যারা চিন্তাভাবনা করতেন এমন একজন মানুষকে হারালাম। যখনই আমরা তাকে ডাক দিয়েছি নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করে তিনি ছুটে আসতেন। মাদরাসার জন্য কাজ করতেন।
খড়কীতে আমাদের ভাই-বোনদের জন্ম। এ গ্রামকে আমরা খুবই ভালোবাসি। আমাদের ভাই-বোনরাও গ্রামকে ভালোবাসেন। এ মাদরাসাটিকেও আমরা ভালোবাসি। তেমনিভাবে আল্লাহর জন্যই মাওলানা হারুনুর রশিদ রহ.কেও আমরা ভালোবাসতাম। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের গ্রামের প্রতিটি মানুষের আজ হৃদয় ভেঙেছে। এমন একজন আলেমের জন্য যুগ যুগ ধরে মানুষ অপেক্ষা করতেই থাকবে।
Leave a Reply