‘বাবা’, ছোট্ট একটি শব্দ, কিন্তু এই শব্দ অনেক বড় অর্থ বহন করে। দুই অক্ষরের এই ছোট শব্দটি প্রতিটি সন্তানের কাছে অনেক আবেগ ও অনুভূতির, যে শব্দের মাঝে লুকিয়ে থাকে হাজারো ত্যাগ তিতিক্ষার গল্প। বাবা মানে সন্তানের মাথার উপর শীতল কোমল ছায়া, ঝুম বৃষ্টি বা তীব্র রোদে সন্তানের জন্য শান্তিদায়ক ছাতা, আবার অন্ধকারে পথ দেখানোর আলো। প্রতিটি সন্তানের কাছেই বাবা যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা, ছায়া দানকারী বিশাল মহিরুপের স্বরুপ। তেমনই আমার কাছেও আমার বাবা পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তি, আমার বেঁচে থাকার শক্তি। আমার বাবা ই আমার সেরা শিক্ষক, বন্ধু ও পথনির্দেশক। অনেকে বলে, বাবার কাছে মেয়ে সন্তান রা বেশি প্রিয় হয়, আবার বাবা রা মেয়ে সন্তানদের থেকেই বেশি যত্ন পেয়ে থাকেন। এই কথাটাই হয়তো যুক্তি নেই, তবে বোধহয় খুব একটা ভুল ও নেই। বাবার জন্য মনে বিশেষ দূর্বলতা নেই এমন মেয়ে হয়তো খুব কমই আছে পৃথিবীতে।
আমার বাবা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। গ্রামে বড় হয়েছেন তিনি, পড়াশোনায় খুব বেশিদূর এগোতে না পারলেও এই জগৎ সম্পর্কে জানার দিক থেকে তার কমতি নেই। বাবার থেকে প্রতিটি মুহূর্তে শিখি কিভাবে ভালো মানুষ হওয়া যায়। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি আমাদের দুইবোন কে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি সবসময় চেষ্টা করতে থাকেন, সঠিক দিকনির্দেশনা দেন। তার স্বল্প আয়ের ব্যবসা থেকেই সংসার চালানো, আমাদের লেখাপড়ার খরচ সহ সবকিছু চালিয়ে নিতে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয়, কিন্তু তাতেও কোনোসময় আমাদের দুইবোনকে কোনো জিনিসের অভাবে পড়তে দেন নি। আর সবসময় একটি কথাই বলেন যে, ‘মানুষ হতে হবে, মা’, “তোমার এই বাবা যতদিন আছে, কোনো কিছুর অভাবে কখনো পড়তে হবে না তোমাদের”। বাবার এই কথা টা যেন সবসময় মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে, সবসময় অনুপ্রেরণা জোগাতে থাকে। বাবার কাছে চাহিদার শেষ থাকে না। আমার মনে আছে, সেই ছোট বেলায় মজা বিস্কুট নামে একটি বিস্কুট খেতে আমি খুবই পছন্দ করতাম, আর প্রতিদিন রাতে বাড়ি আসার সময় সেটা বাবা কে কিনে আনতেই হতো, যদি কোনোদিন ভুলে যেত, তাহলে বাড়ি ফিরেও আবার বাজারে চলে যেত সেই বিস্কুট কিনতে। আর ঈদের সময় তো নতুন জামা চাই-ই-চাই, নিজে পুরোনো কাপড় পরে থাকলেও আমাদের এসব ছোট-বড় চাহিদা গুলো কখনো অপূর্ণ রাখেন নি বাবা। এভাবেই উঁচু বটবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে সবসময় ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন আমাদের বাবা। মানুষ প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলেছে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য, আর সকল বাবা সংগ্রাম করে চলেছেন সন্তানদের টিকিয়ে রাখার জন্য। তবে এই বুঝি নিঃস্বার্থ ও শর্তহীন ভালোবাসা? যা কেবল বাবা কিংবা মায়ের কাছেই পাওয়া যায়। তাই হয়তো গুনীজনরা বলে গিয়েছেন যে, “পৃথিবীতে খারাপ মানুষ আছে ঠিকই, কিন্তু খারাপ বাবা একটিও নেই”।
কিন্তু এখন সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে, পরিবর্তন হচ্ছে সমাজের মানুষের আচার-আচরণ ও পারিবারিক বন্ধন আর ব্যস্ততায় নিমজ্জিত হচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। উচ্চশিক্ষা অর্জন, কর্মকান্ডের সুযোগ-সুবিধার জন্য বা বিভিন্ন কারণে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকছে অনেকেই। যে বাবা-মায়ের হাত ধরে হাঁটতে শিখেছি, যাদের মুখ থেকে কথা বলতে শিখেছি, যারা সবসময় আমাদের কল্যাণের চিন্তা করেন, ভুল করলে তা সংশোধন করে দেন এবং জীবনের সফল হওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা যে বাবা-মায়ের থেকে পেয়ে থাকি, এখন তাদের সাথে খুব অল্প সময় কাটানো হয় আমাদের। কেউ বা বৃদ্ধা বয়সে বাবা-মা কে রেখে আসি বৃদ্ধাশ্রমে। এই কি সন্তানদের ধর্ম হওয়া উচিত? সন্তানদের প্রতি যেমন বাবার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি, তেমনই সন্তানদের ও বাবার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আজকের এই বাবা দিবসে আহ্বান জানায় আমার মতো হাজারো সন্তানকে, আমরা সন্তানরা যেন কখনোই বাবা-মায়ের প্রতি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে না যায় এবং সালাম ও শ্রদ্ধা জানায় বিশ্বের প্রতিটি বাবাকে।
লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
Leave a Reply