মুহাম্মদ ইমদাদুল হক ফয়েজী
অর্থনীতিতে চলছে চরম মন্দা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লাগামহীন মূল্য, সিন্ডিকেট ও অস্থিতিশীলতা, দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন, বেকারত্ব ইত্যাদিতে বিপর্যস্ত জনজীবন। এরইমধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গা, বিশেষত সিলেট শহর ও কয়েকটি উপজেলার উল্লেখযোগ্য অংশে ভারত থেকে আসা পানিতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। পানিতে তলিয়ে গেছে এসব জনপদের বাড়িঘর, প্রতিষ্ঠান, রাস্তঘাট, হাটবাজার, ক্ষেত-খামার সবকিছুই। সর্বত্রই পানি আর পানি। ফলে স্থানীয় মানুষজন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। যাদের পরিবারে কেউ অসুস্থ, শিশু সন্তান বেশি কিংবা যাদের পশুপাখি রয়েছে তাদের তো দুর্ভোগের সীমা নেই। এমনকি এমন অনেক স্থান রয়েছে, যেখানে দু’টি পা রাখার মতো একখ- শুকনো মাটি নেই। আল্লাহ না করুন, এসব স্থানে কেউ মৃত্যুবরণ করলে পানিতে দাঁড়িয়ে জানাযা আদায় করে, মৃতদেহ পানিতেই ভাসিয়ে দিতে হবে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার্ত মানুষজন আশ্রয় নিচ্ছেন। কিন্তু একেকটি জনপদের জন্য একটি-দু’টি স্কুল কতটুকুই বা পর্যাপ্ত? একদিকে আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যাধিক্য, আবার অনেক জায়গায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও বানের পানি। ফলে কার্যত এতে তেমন উপকার হচ্ছে না। বন্যাদুর্গত প্রায় সকল স্থানে বিশুদ্ধ পানি থেকে শুরু করে খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ, নিত্যপণ্য, চিকিৎসাসামগ্রী ইত্যাদিতে চরম অভাব-অসহায়ত্ব দেখা দিয়েছে।
অসহায়-দুর্গত বানবাসীদের মাঝে সরকারি-বেসরকারি ত্রান তৎপরতা, সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য নয়। দুয়েক জায়গায় কিছুটা দেখা গেলেও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে খুবই স্বল্প, সীমিত। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তায়ালা বন্যার্ত মানুষদের তুলনায় আমাদের ভাল রেখেছেন, সুখে-শান্তিতে রেখেছেন। আমরা যারা বন্যা পরিস্থিতি থেকে নিরাপদ রয়েছি, আমাদের মানবিক দায়িত্ব হচ্ছে, নিজেদের উপলব্ধি ও বিবেকবোধ জাগ্রত করা, বন্যকবলনিত অসহায় মানুষদের কথা ভাবা। দয়া ও ভালবাসা পরবশ হয়ে আরোও আন্তরিকতার সাথে বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসা।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যারা নিজেদের ধন-সম্পদ রাতে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তাদের প্রতিদান তাদের রব-এর নিকট রয়েছে। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’ (সূরা বাকারা : আয়াত ২৭৪)। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘বান্দা যতক্ষণ তার অপর মুসলিম ভাইয়ের সাহায্য করে আল্লাহও ততক্ষণ তার সাহায্য-সহযোগিতা করেন।’ (মুসলিম)। অন্যান্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, দান-সদকা বিপদ-বিপর্যয় দূরীভূত করে, জীবনে সমৃদ্ধি এনে দেয়। পাপমোচন করে, ক্ষমা লাভের মাধ্যম হয়। আল্লাহর ক্রোধ থেকে বাঁচিয়ে রাখে। অসুখ-বিসুখ থেকে সুস্থতা পাওয়া যায়।
নাম কুড়ানো, লৌকিকতা কিংবা দায়সারাভাবে নয়; মনুষ্যত্ব ও মানবতার দায়িত্ববোধ নিয়ে সাধ্যানুযায়ী বন্যাদুর্গত, অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে হবে। ইসলামের অন্যতম আদর্শ ও শিক্ষা হচ্ছে, অসহায়-বিপদগ্রস্তদের দুঃখ-কষ্ট নিবারণ করা, ক্ষুধার্তকে আহার দান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান, রোগীর সেবা-শুশ্রূষা করা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর আত্মীয়স্বজনকে দাও তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্থ ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপচয় কর না।’ (সুরা ইসরা : আয়াত ২৬)। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিপদগ্রস্ত মানুষের কোনো দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, বিচারদিনে আল্লাহ তায়ালা তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন।’ (বুখারি)। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞেস করেন, ইসলামে উত্তম কাজ কোনটি? রাসুল (সা.) উত্তরে বললেন, ‘অন্যকে আহার দেওয়া।’ (বুখারি, মুসলিম)।
কথায় আছে—‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য।’ আমাদের হৃদয়টাকে আরোও প্রশস্ত করতে হবে। অহমিকা, সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলতে হবে। বন্যাদুর্গত এলাকায় যাদের বাড়িঘর তুলনামূলক শুকনো, পানিমুক্ত বা তুলনামূলক ভাল অবস্থানে যারা রয়েছেন, কষ্ট হলেও তারা পারস্পরিক কল্যাণকামীতার দায় নিয়ে কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। দুর্গত প্রতিবেশি, মহল্লাবাসীদের একটু স্থান করে দিতে হবে, যাতে করে বিপদগ্রস্ত মানুষেরা অন্তত মাথাটা নিরাপদে রাখতে পারেন। যাদের রান্নাঘর-চুলো শুকনো রয়েছে, তারা অসহায়দের রান্না করার একটু সুযোগ করে দিন। সামর্থ্য থাকলে দু’ মুঠো ভাত আর তরকারিতে একটু পানি বাড়িয়ে দিয়ে হলেও বন্যাপ্লাবিতদের আহার দান করুন। আবু জর (রা.) বর্ণনা করেন, একবার নবীজি (সা.) বলেন, ‘আবু জর, তুমি যখন তরকারি রান্না করো তখন তাতে পানি বাড়িয়ে দাও এবং তোমার প্রতিবেশীকে পৌঁছে দাও।’ (মুসলিম)।
রাসুল (সা.) আরোও বলেন, ‘ওই ব্যক্তি মুমিন নয় যে পেটপুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে।’ (আদাবুল মুফরাদ)। যেসব স্থানে পানির সংকট দেখা দিয়েছে, সেসব স্থানে যাদের বিশুদ্ধ বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা রয়েছে, তারা নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে সবার জন্য তা উন্মুক্ত করে দিন। মানবতার কল্যাণে ভূমিকা রাখার থেকে উত্তম কী হতে পারে? মানুষের প্রতি ভালবাসা বিলিয়ে দিন। টাকাপয়সা, ধনসম্পদ ব্যয় না করেও উত্তম সদকাকারী হোন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘উত্তম সদকা হচ্ছে মানুষকে পানি পান করানো।’ (আবু দাউদ)।
রাসুল (সা.) আরোও ইরশাদ করেন, ‘উত্তম ব্যক্তি সেই যে মানুষের কল্যাণ করে।’ সময় এখন সহযোগিতার। হৃদ্যতা ও সহানুভূতির। আসুন, নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানবতার তরে সামর্থ্যের আলোকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করি। মানুষের কল্যাণসাধনে সর্বাত্মক চেষ্টা-সাধনা করি। বিশেষত, মহৎ এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে বন্যার কবল থেকে মুক্ত প্রতিবেশী—ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলার বিত্তবানদের। সাধ্যানুযায়ী সচেষ্ট হতে হবে সকলকে। সরকারিভাবে দ্রুত বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সরবরাহ এবং সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা বৃদ্ধি করাও সময়ের অপরিহার্য দাবি।
Leave a Reply