প্রাচীন বাংলার দরবেশ
মামুন আবদুল্লাহ
একবিংশ শতাব্দির শুরুতে এসে সুফি-দরবেশদের নিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে বিশেষ ধরনের আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। জাতিসংঘ ২০০৭ খ্রিস্টীয় বছরকে বিখ্যাত সুফি-দরবেশ জালালুদ্দিন রুমির নামানুসারে ‘রুমি বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে।
নাইন-ইলেভেনের পরে আমেরিকান ‘গুড মুসলিম’ ও ‘ব্যাড মুসলিম’ পলিসির কারণে যখন মুসলিম সম্প্রদায়কে দুইভাগে ভাগ করে ফেলা হয়। তখন সুফি-দরবেশদের লাইম-লাইটে এনে নতুন কিছু ট্যাগ তৈরি করা হয়। তাদের কাজ-কর্মকে নানান মুখরোচক অর্থে ব্যখ্যা করা শুরু হয়। সুফি-দরবেশরা হয়ে উঠেন গুড মুসলিমের আদর্শ উদাহরণ। ধার্মিকতার চেয়ে কথিত মানবিকতাকে তাঁরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বলে প্রচার শুরু হয়।
হামমাদ রাগিবের ‘প্রাচীন বাংলার দরবেশ’ গ্রন্থটি এসব প্রচারণার বিপরীতে ইতিহাসের মণি-মুক্তা নিয়ে হাযির হয়েছে। লেখক বইটিতে দরবেশদের আধ্যাত্মিক সাধনার পাশাপাশি সংগ্রামী জীবনাচারেরও সন্ধান দিয়েছেন।
১২০৩/১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয়ের মধ্যদিয়ে বাঙলায় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলাম প্রচারের আরো আগের ৩জন দরবেশের ইসলাম প্রচারের আধ্যাত্মিক ও সংগ্রামী সাধনার ইতিহাস পাঠকের সামনে তুলে ধরতে হামমাদ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। প্রত্যেকটি ঘটনাকে তিনি গল্পের ঢঙ্গে ধারাবাহিক বর্ণনা করেছেন।
আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি দরবেশদের সংগ্রামী ঘটনাগুলো পাঠকমনে রোমাঞ্চ সৃষ্টি করবে। প্রত্যেকটি গল্পের শেষে ‘ইতিহাসের বয়ান’ নামে পৃথক শিরোনামে লেখক স্থান, কাল, পরিচয়সহ নানান বিষয়ে বিভিন্ন সোর্স থেকে রেফারেন্স টেনে ইতিহাস বর্ণনার ধারাক্রমকে শক্ত ভীতে দাঁড় করিয়েছেন।
বইয়ের প্রথম গল্পটি শাহ সুলতান বলখি মাহিসওয়ারকে নিয়ে। রাজকীয় জীবন থেকে তাঁর দরবেশি জীবনে প্রত্যর্পণ, বঙ্গদেশে আগমন, রাজা বলরামের হরিরামনগরের চিত্র, নরবলির নৃশংস ঘটনা, রাজা পরশুরামের সাথে যুদ্ধ, ইত্যাদি খ- খ- ঘটনার বর্ণনা এ গল্পে পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় গল্পটি দরবেশ কমরউদ্দিন রুমিকে নিয়ে। এ গল্পে হিন্দু সম্প্রদায়ের তৎকালীন সতীদাহপ্রথার নির্মম কাহিনী লেখক বিশ্বস্ততার সাথে বর্ণনা করেছেন। চিতার আগুনে জীবন্ত পুড়ে ভয়ানক মৃত্যুর আগমুহূর্তে একজন নারীর মনের অবস্থা কী হতে পারে এবং চিতারোহণকারিণীর বাবা-মায়ের মনে আকুলতার বর্ণনাও লেখক স্বার্থকভাবে তুলে ধরেছেন।
শেষ গল্পটি হলো- বাবা আদম শহীদকে নিয়ে। সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেনের শাসনামলে গরু কুরবানিকে কেন্দ্র করে ঘটনার শুরু। লেখক প্রচলিত লোকগাথা আর কিংবদন্তির মিশেলে গল্পকে টেনে নিয়ে গেছেন যুদ্ধের ময়দানে। লক্ষণ সেনের পিতা বল্লাল সেনের সাথে যুদ্ধে হামলা প্রতি-হামলার এক পর্যায়ে বাবা আদম শহাদতবরণ করেন। বল্লাল সেনের শেষ পরিণতি ঘটনাও গল্পের শেষে জানা যায়।
হামমাদ রাগিবের গল্পের ভাষা সম্পর্কে বলা যায়Ñ গল্পের ঘটনা অনুযায়ী হামমাদ তার গল্পের ভাষা আবিষ্কার করতে পেরেছেন। ভাষার কারণে গল্পে লেখক নানান নাটকীয়তা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। গল্পে কখনো করুণ দৃশ্যের মঞ্চায়ন, কখনো যুদ্ধের ঘটনা আর অলৌকিক বিষয়ের জীবন্ত প্রকাশ লক্ষ্য করা যায। যেমন প্রকৃতির বর্ণনাÑ ‘জাহাজের গায়ে তীব্র স্রোতের আঘাত লেগে জলের শব্দ হচ্ছে। মেঘহীন আকাশে ফুটেছে দশমীর চাঁদ। চাঁদ থেকে যেন ফুলের রেণুর মতো ঝরে পড়ছে জোছনা। দরবেশ বিছানা ছেড়ে উঠে এলেন। জাহাজের ডেকে এসে বসলেন আসন পেতে। যেন চাঁদের আলোয় জোছনাস্নানে বসেছেন তিনি’। বইটির শুরুতে কবি ও গবেষক মুসা আল হাফিজের অনবদ্য ভূমিকাটি বইটির বিষয়বস্তুকে নিঃসন্দেহে শক্তিশালী ও প্রামাণ্য করে তুলেছে। আলোচক হিসেবে নয়, পাঠক হিসেবেও বইটি পড়ে ভালো লেগেছে। বইটি খুবই দ্রুত পড়ে ফেলা উচিৎ। এটি হামমাদ রাগিবের তৃতীয় বই, প্রতিটি বইয়ে লেখকের উন্নতি আশান্বিত করেছে। এখন চতুর্থ বইটির জন্য অপেক্ষার পালা।
প্রাচীন বাংলার দরবেশ
হামমাদ রাগিব
প্রকাশকাল: আগস্ট ২০২২
প্রকাশক: নবপ্রকাশ
প্রচ্ছদ: হুসাইন মুহাম্মদ ফাহিম
মূল্য: ১২০ টাকা।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
mamunab1122@gmail.com
Leave a Reply