আলম শামস
এগার বছর বয়সী দলিপ্রু মার্মা। সমাজের আট-দশ কিশোরের মতো তারও রয়েছে শিক্ষাগ্রহণ, লেখাধুলা ও বিনোদনের অধিকার। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, সে হাত-পা নাড়াতে পারে না। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে না। সে একজন শরীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু। দলিপ্রু মার্মা অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতে অক্ষম।
বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার ছোট নুনারবিল পাড়া গ্রামের মংচিংনু মার্মার ছেলে দলিপ্রু মার্মা। তার বাবা বলেন, জন্মের পর থেকেই দলিপ্রু অন্য দশটি শিশুর মতো স্বাভাবিক নয়। বয়স বাড়লেও তার স্বাভাবিক মানসিক বৃদ্ধি ঘটেনি। তার শরীরিক বৃদ্ধি ঘটলেও জীবনমুখী আচরণ, বুদ্ধি ও চলাফেরার তেমন কোনো বিকাশ ঘটেনি। চিকিৎসকগণ বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানিয়েছেন দলিপ্রু মার্মার জটিল বিকাশজনিত সমস্যা আছে।
দলিপ্রু মার্মার মা আনু মার্মা জানান, দলিপ্রু মার্মাকে নিয়ে তারা খুবই শংকিত। যে ছেলে নিজে চলতে পারে না, স্বাভাবিক অন্য দশজন ছেলে মেয়ের সাথে সমান তালে চলতে পারে না, তাকে নিয়ে বাবা-মার চিন্তা-ভাবনার অন্ত নেই।
আমাদের আশপাশে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, অনেক পরিবারেই মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে। মানসিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে পরিবারের ভাবনার শেষ নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, গড় হিসাবে পৃথিবীর শতকরা যে কোনো দেশের ৩ শতাংশ মানুষ মানসিক প্রতিবন্ধী। মানসিক প্রতিবন্ধীতার অর্থ হলো, বয়স অনুপাতে শিশুটির যে বুদ্ধি থাকার কথা, তা থাকে কম মাত্রায়। বুদ্ধি বা আইকিউর পরিমাণ কতটুকু কম তার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবন্ধিত্বকে মৃদু, মাঝারি ও তীব্র এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
জন্মের পর থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটা, বসতে শেখা, দাঁত ওঠা, কথা বলা ইত্যাদি কিছুটা দেরিতে শুরু হয়। একটু বয়স হয়ে গেলেও তারা নিজেদের পোশাক নিজেরা পরতে পারে না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পারে না, আকস্মিক বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। কখনো কখনো আগুন শব্দ বলতে পারে না, পানি শব্দ বলতে পারে না, একটু দূরে ছেড়ে দিলে বাড়িতে একা একা ফিরে আসতে পারে না, রাস্তাঘাটে ঠিক মতো চলাচল করতে পারে না।
মানসিক প্রতিবন্ধীদের মানসিক গঠন, মস্তিষ্কের গড়ন, মস্তিষ্ক বা ব্রেনের কাজ ইত্যাদি ধীর গতিতে হয়। অন্য সাধারণ দশটি শিশু থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের কথাবার্তা, চলাফেরা, শারীরিক গঠন, আচার-আচরণ ও ব্যবহার দ্বারা সহজেই পৃথক করা যায়।
এ বিষয়ে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজিস্ট ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুন্ডু বলেন, সমাজের সাধারণ দশটি শিশু থেকে আচরণগত ও বিকাশগত তফাৎ থেকে আমরা মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের চিহ্নিত করতে পারি। শিশুর শৈশবে মারাত্মক কোনো সংক্রমণও শিশুর ওপর ভয়াবহ প্রভাব সৃষ্টি করে শিশুর মানসিক গঠন প্রতিবন্ধীতা তৈরি করতে পারে।
মানবমস্তিষ্কে এবং স্পাইনাল কর্ড বা সুষুম্নাকান্ডকে ঘিরে এক ধরণের আবরণী পর্দা রয়েছে, একে বলা হয় মেনিনজেস। ব্যাকটেরিয়াল, ভাইরাল এবং প্রোটোজোয়াজনিত সংক্রমণের কারণে মানবমস্তিষ্কের সেই পর্দা আক্রান্ত হতে পারে। এভাবে মানবমস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেলে শিশু মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী হতে পারে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ লোকই দরিদ্র। সে হিসেবে বাংলাদেশে আমিষ, শর্করা ও স্নেহজাতীয় খাবারের স্বল্পতার জন্য অল্প বয়সে অনেক শিশুই মানসিক প্রতিবন্ধীত্বের শিকার হয়ে থাকে। শরীর ও মনের পরিপূর্ণ গঠনের জন্য যে ধরনের ও পরিমাণ পুষ্টি প্রয়োজন, সেসব হতে আমাদের দেশের অধিকাংশ নাগরিকই বঞ্চিত।
বংশগত বা জেনেটিক কারণেও ব্যক্তির মাঝে মানসিক প্রতিবন্ধীত্ব দেখা দিয়ে থাকে। এগুলো হলো-উইলসন্স ডিজিজ, ক্রমোজোমাল ডিজঅর্ডার, যেমন- ডাউন সিনড্রোম, ফিনাইল কেটোনইউরিয়া, নিউরাল টিউবের সমস্যা, যেমন- পলিজেনিক ডিজঅর্ডার, ক্লিনফেলটার্স সিনড্রোম, রুবেলা/সিফিলিস বা টক্সোপ্লাজমোসিসজনিত কারণে স্নায়ুতন্ত্র সম্পর্কীয় সমস্যা, যেমন- হাইড্রোকেফালাস, মাইক্রোকেফালি ইত্যাদি।
মায়ের গর্ভ থেকে বাচ্চা জন্ম নেয়ার সময় মস্তিষ্কে কোনো ধরনের আঘাত পেলে বাচ্চা মানসিক প্রতিবন্ধী হতে পারে। আবার অনেক বাচ্চা রয়েছে, যারা পূর্ণতা পাওয়ার আগেই পৃথিবীর আলো দেখে। এ ধরনের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে শারীরিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। যেসব শিশু এ সমস্যায় ভোগে, তাদের স্নায়ুতন্ত্র সম্পূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করে না। ফলে এরা পরে মানসিক প্রতিবন্ধীত্বের শিকার হয়।
সমাজ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলেও কোনও কোনও মানুষের মানসিক প্রতিবন্ধীত্ব সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণে শিশুর মানসিক প্রতিবন্ধীত্ব সৃষ্টি হতে পারে।
বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও পারিবারিক ইতিহাস বিশ্লেষণ ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক প্রতিবন্ধীত্বের প্রকৃতি ও গাঢ়ত্ব নির্ধারণ করা হয়। যেমন-শিশুর কর্মদক্ষতার বিশ্লেষণ, আইকিউ, পেশিশক্তির বিকাশ, শিশুর ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা, কানে কম শোনা, দৃষ্টিশক্তিহীনতা, সামাজিক বিকাশ এবং ব্যক্তিগত ও অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সামঞ্জস্য বিধান। শরীরের বিকলাঙ্গতা বের করতে পূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।
এজন্য শিশুর মেডিকেল ইতিহাস বা জন্ম নেয়ার আগে গর্ভাবস্থায় মায়ের শারীরিক অবস্থা ও জন্মের পর থেকে চিকিৎসকের নিকটে আসা পর্যন্ত শিশুর বিকাশজনিত বিভিন্ন সমস্যার বিস্তারিত ইতিহাস নিতে হবে। যেমন- প্রসবকালীন কোনো জটিলতা হলো কি না, গর্ভাবস্থায় কোন জটিল সমস্যা বা মায়ের কোন বিশেষ রোগ ছিল কি না। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ধাপ, বাচ্চা হওয়ার সময় মস্তিষ্কে আঘাত পেয়েছে কি না, শিশুর সংক্রামক ব্যাধি, যেমন – মেনিনজাইটিস, রক্তের সম্পর্ক রয়েছে এমন আত্মীয়স্বজনের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক ইত্যাদি।
অপ্রিয় হলেও সত্য, মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের মা-বাবার অবগত হওয়া প্রয়োজন যে, পৃথিবীতে কোথাও এখনো কোন ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি, যা দ্বারা এই মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের বুদ্ধি বাড়ানো যেতে পারে। তবে আশ্বস্ত হওয়ার মতো সংবাদ হলো, বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের মানসিক ও শারীরিক অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব।
সরকারের পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি সুস্থ নাগরিককেই দায়িত্ব হবে প্রতিবন্ধী শিশুদের আন্তরিকভাবে ভালোবাসতে হবে। সমাজের সবার সাথে যোগাযোগ ও তথ্য আদান প্রদানে তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাকে একটি বিশেষ কাজে দক্ষ করে তুলতে হবে। কর্মমুখী পেশার প্রতি তাকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। খেলাধুলা বিনোদনে প্রতিবন্ধী শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অনেক প্রতিবন্ধী শিশুদের মাঝে ছবি আঁকা, গান, ক্রীড়া, গণিতে বা কম্পিউটারে দক্ষতা থাকে, তা যথাযথভাবে প্রয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, এদের মাঝে অনেকই অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। প্রতিবন্ধী শিশুদের ঠিকমত পরিচর্যা করতে পারলে এরা সমাজকে অনেক কিছু দিতে পারে। তবে আশার কথা হলো বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধী ও অটিজম শিশুর চিকিৎসা ও উন্নয়নে সময় উপযোগী আধুনিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা এসব শিশুর মানসিক বিকাশে কার্যকর অবদান রাখছে। আসুন, আমরা সবাই সরকারের পাশাপাশি প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেই। তাহলে প্রতিবন্ধী শিশুদের চলার পথ যেমন মসৃণ হবে, তেমনি অভিভাবকদের কষ্টও অনেকাংশে লাঘব হবে।
লেখক : মফস্বল সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব। ইনকিলাব
Leave a Reply