ওবায়দুল্লাহ হামযাহ
কওমি শিক্ষার্থীর গাইড পরিহার কাম্য
কওমী মাদরাসার ছাত্রদেরকে অবশ্যই গাইড নির্ভরতা পরিহার করতে হবে। গাইড নির্ভরতা ধীরে ধীরে স্কুল-আলিয়ার পর্যায়ে নিয়ে যাবে যা কওমী মাদরাসার জন্য কখনো শোভা হবে না। অধুনা কালের সিংহভাগ ছাত্র গাইড নির্ভর অর্থাৎ মূল কিতাবের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। গাইড দেখে দেখেই পরীক্ষা দিয়ে দেয়। এরকম গাইড নির্ভর পরীক্ষায় হয়তো মারকায পাওয়া যাবে বা ক্লাসে এক নাম্বার হওয়া যাবে কিন্তু কিতাবি ইসতিদাদ মোটেও হবে না। সহিহ-শুদ্ধ করে ইবারত পড়ার যোগ্যতাও তৈরী হবে না। কারণ মূল কিতাবের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। সারাবছর শুধু গাইড দেখে দেখে অধ্যয়ন করেছে।
এক্ষেত্রে আরেকটা সমস্যা হলোঃ পরীক্ষার আগ মুহূর্তে বিশেষ করে মারকাযী পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিগত দশ-বিশ বছরের প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে শুধু সেই প্রশ্নের উত্তরগুলো ক্লিয়ার করা। এটার কারণে ছাত্রদের দুইটা ক্ষতি। একটা হলো যদি পরীক্ষায় তার বাছাইকৃত প্রশ্ন গুলো না আসে তাহলে সেই ছাত্র ধরা খেয়ে যাবে। আরেকটা হলো পরীক্ষা উপলক্ষে তার পুরো কিতাব দেখা হবে না। কারণ সে শুধু বিগত দশ-বিশ বছরের প্রশ্নগুলোর উত্তর দেখেছে। তো এরকম সিস্টেম আমাদেরকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে। অন্যথায় ছাত্রদের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।
তো এক্ষেত্রে বোর্ড-গাইরে বোর্ড পরীক্ষায় প্রশ্নের সিস্টেম পরিবর্তন করে ফেলতে হবে। যাতে ছাত্ররা গাইডমুখী না হয়ে কিতাবমুখী হয়। যেনো প্রশ্নের তর্জ-পদ্ধতি পরিবর্তন করা হয়। আর আপনারা হয়তো জানেন (বিশেষ করে যারা ইত্তিহাদ সংশ্লিষ্ট) ইত্তিহাদের গতবছরের (১৪৪১-৪২ হি.) পরীক্ষার প্রশ্নের পদ্ধতি সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। যা বিগত বছরের প্রশ্নের সঙ্গে কোনো মিল নেই। যার কারণে অনেক মাদরাসার ছাত্র যারা গাইড নির্ভর করেছিল, তারা ভালো করতে পারেনি। আর ইত্তিহাদ বোর্ড কর্তৃপক্ষ সামনে থেকে এ পদ্ধতিতে প্রশ্ন করাটা চালিয়ে যাবে। যাতে ছাত্ররা গাইড নির্ভরতা পরিহার করে। তো কওমী মাদরাসার ছাত্রদেরকে অবশ্যই গাইড নির্ভরতা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে হবে। আর মূল কিতাবের প্রতি ঝুঁকতে হবে। কিতাবের ইবারত সহিহ-শুদ্ধভাবে পড়ে সেখান থেকেই মাসআলা-মাসাইল ও যাবতীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-তাশরীহ বের করতে হবে। এ বিষয়ে মাদরাসার জিম্মাদারকে উদ্যোগী হতে হবে এবং প্রত্যেক শ্রেণির জিম্মাদারকে তদারকি করতে হবে। ছাত্ররা যেনো গাইড না নিয়ে মূল কিতাব থেকেই যাবতীয় সব পড়া পড়তে পারে সেই যোগ্যতা তৈরী করাতে হবে।
ছাত্রদেরকে ছোট বেলা থেকেই আরবির প্রতি ধাবিত করে তুলতে হবে। নিচের শ্রেণি থেকে ছাত্ররা যেনো পরীক্ষার উত্তরপত্র আরবীতে লিখতে পারে এবং আরবী শরাহ মুতালাআ করে সেভাবে তৈরী করতে হবে। আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান জামাতে হাশতুমের (অষ্টম শ্রেণি) বছর সৌদি আরব থেকে আরবী ডিকশিনারি এনেছিলেন। চিন্তা করেছেন? তিনি হাশতুমের বছর থেকে আরবী ডিকশিনারি ব্যবহার করেছিলেন অথচ বর্তমানে হিদায়ার ছাত্রদের কাছেও ডিকশিনারি নেই! আফসোস! অনেক ছাত্র তো এরকমও আছে যারা দারস-তাদরীসের পুরো একটি অধ্যায় কওমী মাদরাসায় ব্যয় করেছেন অথচ একটা ডিকশিনারিও কিনেনি।
আমি জামাআতে হাফতুম (সপ্তম শ্রেণি) থেকেই পরীক্ষার উত্তরপত্র আরবীতে লিখতাম। অথচ বর্তমানে দাওরার ছাত্রও আরবীতে উত্তরপত্র লিখতে পারছে না। এটা অবশ্যই লজ্জার বিষয়। গতবছর তিরিশ হাজার ছাত্র-ছাত্রী হাইআতুল-উলইয়ার পরীক্ষা দিয়েছে কিন্তু ভালো আরবী বলতে পারে লিখতে পারে বা বুঝতে পারে এরকম তিন শ জনও পাওয়া যাবে না। শত আফসোস! এটার জন্য কারা দায়ী? এর দায়ভার কারা নিবে?
একজন ছাত্র ছোট মাদরাসায় হাশতুম, শাশুম, ছাহারুমে স্ট্যান্ড করেছে। কিন্তু সেই ছাত্র বড়ো কোনো জামিআতে গিয়ে ভালো করে হাদিসের ইবারতটুকুুও পড়তে পারছে না। তাহলে তার পরপর তিনবার স্ট্যান্ড করাটা কী কাজে এলো? অহেতুক। আজকালের ছাত্ররা যেভাবে উর্দু শরাহ নিয়ে পড়ে থাকে অথচ তার সিকিভাগও যদি আরবী শরাহ মুতালাআ করতো তাহলে কতোই না উপকার হতো। কিন্তু এটার জন্য এককভাবে ছাত্রদের দোষ দিয়ে লাভ কী? পুরো পরিবেশটাই এরকম হয়ে গেছে অর্থাৎ উর্দু শরাহ নির্ভর। শুরু-শেষ সবাই উর্দু শরাহ পড়ছে। কেউ আরবী শরাহ পড়ছে না। পড়বেই বা কীভাবে? যেখানে উস্তাদ পর্যন্ত উর্দু শাহা দেখে ছাত্রদেরকে দারস দিচ্ছেন!
আমি উর্দুর বিরোধিতা করছি না কিন্তু গণহারে উর্দু নিয়ে পড়ে থাকাও অবশ্যই বিপজ্জনক।
কওমী মাদরাসার ছাত্রদের সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা আছে। যা থেকে অবশ্যই আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। গড্ডালিকা প্রবাহের ন্যায় গা ভাসিয়ে দিলে হবে না। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। মাদরাসার ভিতরে শিক্ষাগত কাঠামো-সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। ছাত্ররা কীভাবে আরবীতে উন্নতি লাভ করবে সে বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
এক্ষেত্রে শুধু মাদরাসা ওয়ালাকে দোষারোপ করলে হবে না বরং অনেকাংশে অভিভাবকরাও দায়ী। প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত তার ছেলের তদারকি করা। তার ছেলে কী পড়ছে? কীভাবে পড়ছে? কতটুকু পড়ছে? এছাড়া একজন ছাত্র পুরো সপ্তাহ মাদরাসায় থেকে ভালো করে লেখাপড়া করেছে কিন্তু জুমাবারে বাড়ি গিয়ে মোবাইল-ট্যাব বা টেলিভিশন নিয়ে ব্যস্ত। তো সেই ছেলে কীভাবে লেখাপড়া করবে? বা সে লেখাপড়ায় ভালো হলেও মোবাইল-টেলিভিশনে তার চরিত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আদীব হুজূর হযরত মাওলানা আবূ তাহের মিছবাহ ছাহেব হাফি. বলেছেন, জাওয়াল (মুঠোফোন) ছাত্রদের জন্য কালসাপ। তো একজন ছাত্র আদর্শবান হওয়ার জন্য অভিভাবকেরও অনেক দায়দায়িত্ব আছে।
লেখক : সহকারী পরিচালক, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
Leave a Reply