ইমাম মাওয়ারদি রহ.
ইলিয়াস মশহুদ
ইসলামি ইতিহাসে যে-সকল বিখ্যাত ব্যক্তি চিন্তা, গবেষণা, লেখালেখিসহ ইতিহাস, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে আজীবন কাজ করেছেন, মৃত্যুর হাজার পরেও যাঁদের অবদান পৃথিবীর দিকে দিকে চর্চিত হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন আবুল হাসান আল মাওয়ারদি (রহ.)। তিনি ৩৬৩ হিজরি মোতাবেক ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকের বসরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৪৫০ হিজরি মোতাবেক ১০৫৮ খ্রিষ্টাব্দে বাগদাদে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পুরো নাম আবুল হাসান আলি বিন মুহাম্মদ বিন হাবিব আল মাওয়ার্দি।
তিনি বাগদাদেই শিক্ষাগ্রহণ করেন। অল্প বয়সে আরবি সাহিত্যে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। আইনশাস্ত্রের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল, ফলে আইনকেই তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। শিক্ষার্জন শেষে খিলাফতের রাজধানী বাগদাদে বিচারক তথা কাজির পদ অলংকৃত করেন। তবে তাঁর অমর কীর্তি হচ্ছে গবেষণালব্ধ লেখালেখি।
কিতাব লেখার ক্ষেত্রে ইমাম মাওয়ারদি (রহ.)-এর ইখলাসপূর্ণ একটি আশ্চর্য ঘটনা বর্ণিত আছে। তিনি তাফসির, ফিকহ ও অন্যান্য বিষয়ে অনেক কিতাব রচনা করেছেন। যদিও তাঁর কোনো গ্রন্থ তাঁর জীবদ্দশায় আলোর মুখ দেখেনি। তিনি এসব কিতাব লিখেছেন এবং সেগুলো গোপন এক জায়গায় লুকিয়ে রাখতেন, যে জায়গাটির কথা কেউ জানত না। তিনি যখন মৃত্যুশয্যায় উপনীত, তখন তাঁর বিশ^স্ত একজনকে বললেন, ‘আমার লিখিত কিতাবগুলো অমুক অমুক জায়গায় রয়েছে। আমি কিতাবগুলোকে আমার জীবদ্দশায় প্রকাশ করিনি এ কারণে যে, আমি আমার নিয়তকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য খালিস করতে পারিনি। যখন তুমি আমাকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে দেখবে, তখন তোমার হাত আমার হাতের ওপর রাখবে। আমি যদি তোমার হাত চেপে ধরি, তাহলে বুঝতে পারবে আমার কোনো আমলই আল্লাহর দরবারে কবুল হয়নি। তখন তুমি আমার লেখা সব কিতাব সঙ্গে করে নিয়ে যাবে এবং টাইগ্রিস (দিজলা) নদীতে ছুড়ে ফেলবে; আর যদি আমার হাত প্রশস্ত হয়, তাহলে বুঝতে পারবে আমার আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে। আমি আল্লাহর নিকট যা আশা করেছিলাম, তা পেয়ে গেছি।’
লোকটি বলল, ‘যখন তাঁর মৃত্যু ঘনিয়ে এল, তখন আমি আমার হাত তাঁর হাতের ওপর রাখলাম। তিনি তাঁর হাত প্রশস্ত করলেন অর্থাৎ, আমার হাত চেপে ধরেননি। সুতরাং আমি এটাকে তাঁর আমল কবুল হওয়ার আলামত হিসেবে গ্রহণ করলাম এবং তাঁর কিতাবসমূহ প্রকাশ করলাম।’
বর্তমানের লেখকরা যেভাবে নিজেদের বইয়ের ভূমিকা বিখ্যাত কাউকে লিখে দিতে বলেন, তাদের সম্পর্কে প্রশংসাসূচক কিছু বলতে বলেন এবং গ্রন্থস্বত্ব নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেন, তিনি এমনটি করেননি। এর বিপরীতে ইমাম মাওয়ারদি তাঁর নিয়ত পর্যবেক্ষণের দিকে অধিক মনোযোগ দিয়েছিলেন। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, তাঁর নিয়ত খালিস নয়। এ জন্য তিনি কিতাব প্রকাশ করা থেকে বিরত ছিলেন।
দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চেয়ে অন্তরের আমলের জন্য অধিক সচেতনতা ও মুজাহাদা প্রয়োজন। অন্তর যদি সংশোধিত, দোষত্রুটি, অসুস্থতা ও অপূর্ণতা থেকে মুক্ত হতে পারে, তাহলে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আমল কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হবে। সুতরাং অন্তর ও তার আমলের সংশোধন হলো মুখ্য এবং সর্বাপেক্ষা অপরিহার্য বিষয়। কারণ, একটি পরিশুদ্ধ অন্তর ব্যতীত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আমলসমূহের মধ্যে কোনো কল্যাণ পাওয়া যায় না; আর ইখলাস হলো অন্তরের আমলসমূহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং সব ইবাদতের ভিত্তি। এটি ইসলামের মৌলিক উপাদান এবং সকল নবি-রাসুলের দীন প্রচারের অনুপ্রেরণা। কেননা, ইখলাসই হলো সমন্ত ইবাদতের অন্তঃসার ও উদ্দীপনা। এর ওপর ভিত্তি করেই আমল কবুল করা হয় অথবা প্রত্যাখাত হয়।
তথ্যসূত্র : সিয়ারু আলামিন নুবালা : ১৮/৬৬; তারিখুল ইসলাম : ৭/১৬৯।
ফতেহপুর, বড়নগর, গোয়াইনঘাট, সিলেট।
মোবাইল : ০১৭২২৬৭৩৩৭১
বসড়ংযঁফ@মসধরষ.পড়স
Leave a Reply