বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০২:৫৮ অপরাহ্ন

সর্বকনিষ্ঠ বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমান

সর্বকনিষ্ঠ বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমান

গুণীজন

সর্বকনিষ্ঠ বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমান

এ অকুতোভয় লড়াকু মহান মুক্তিযুদ্ধকালে ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে শাহাদত বরণ করেন।

দেশমাতৃকাকে রক্ষার প্রতিজ্ঞা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। বাড়ি থেকে বের হবার সময় জন্মদাত্রী মাকে কথা দিয়ে এসেছিলেন – দেশকে শত্রুমুক্ত করে তবেই বাড়ি ফিরবেন। পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত বাংলাদেশ ঠিকই হয়েছিল, কিন্তু বিজয়ের সে অমৃত আস্বাদন নিতে পারেননি কিশোরযোদ্ধা। তবে তাকে মনে রেখেছে বাংলাদেশ। আমৃত্যু তার অদম্য সাহসিকতার গল্প আজ ইতিহাসে সোানর হরফে লেখা।
সেই মরণপণ লড়াই করা ব্যক্তিটি হলেন মোহাম্মদ হামিদুর রহমান। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। ২৫শে মার্চে ঢাকায় দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর অতর্কিত হামলা চালালে দেশপ্রেমিক হামিদুর রহমান দেশ মাতৃকার মুক্তির স্বপ্নে যোগ দেন মুক্তিবাহিনীতে । অংশগ্রহণ করেন একের পর এক যুদ্ধে। মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা মরণোত্তর ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় তিনি তাদের অন্যতম। মাত্র আঠারো বছর বয়সে শহীদ হওয়া হামিদুর রহমান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।
হামিদুর রহমান ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন যশোর জেলার (বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলা) মহেশপুর উপজেলার খোরদা খালিশপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তার পিতা আক্কাস আলী মন্ডল ছিলেন দিনমজুর এবং মাতা মোসাম্মাৎ কায়দাছুন নেছা ছিলেন গৃহিনী। শৈশবে তিনি খালিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে স্থানীয় নৈশ স্কুলে সামান্য লেখাপড়া করেন। অতি শৈশব থেকেই বাস্তবতার সাথে তাকে প্রতি নিয়ত সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছিল। দারিদ্রের কষাঘাত তাকে উচ্চ শিক্ষার পথ থেকে বঞ্চিত করলেও জীবন সংগ্রামী হামিদুর পিছিয়ে থাকতে চাননি।
হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান হামিদুর রহমানের সার্বিক পরিস্থিতি পড়াশোনার জন্য অনুকূলে ছিল না। ভূমিহীন কৃষক আক্কাস আলী মণ্ডল ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পৈত্রিক ভিটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার চাপড়ার ডুমুরিয়া গ্রাম ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। দিনমজুরী করে অন্যের ঘরদুয়ার বেধে দিতেন তিনি। একটু বয়স হলে হামিদুর রহমান নিজেই পূর্ণাঙ্গ দিনমজুর হয়ে গেলেন।
এরপর তিনি আনসার বাহিনীতে যোগ দেন ১৯৭০ সালের শেষ দিকে। আনসার বাহিনী ছেড়ে দিয়ে ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সিপাহি হিসেবে যোগদান করলেন হামিদুর। চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে পাঠানো হলো তাকে প্রশিক্ষণের জন্য। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তার সৈনিক নম্বর বিএসএস নং- ৩৯৪৩০১৪।
পূর্ব পাকিস্তানে তখন রাজনীতির ভাঙ্গাগড়ার খেলা চলছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনি প্রধান জেনারেল হামিদ খান চট্টগ্রামে এসে ২০ বালুচ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফাতমির সাথে শলাপরামর্শ করেন, কী করে বাঙালি সৈনিকদের হত্যা করা যায়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল সৈনিকদের অস্ত্রাগারে অস্ত্র জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। বাঙালি অফিসাররা বিষয়টা বুঝে ফেলে। পঁচিশে মার্চ বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের সেনারা হামলা চালায় সেখানে। হত্যা করে অসহায় ২৫০০ রিক্রুট এবং অন্যান্য বাঙালি সৈনিকদের বেশিরভাগকে। সেই সময় হামিদুরও ব্যারাকে ছিলেন। জীবন বাঁচাতে আরও কয়েকজনের সাথে ব্যারাকের পশ্চিমপাশের জঙ্গলঘেরা পাহাড়ে আশ্রয় নেন তিনি।
পরদিন হামিদুর পাহাড়ের অন্যপাশ দিয়ে নিচে নামতে থাকেন। এরপর অন্য কোনও যানবাহন না পেয়ে হাঁটতে থাকেন বাড়ির দিকে। দশদিন হেঁটে বাড়ি ফিরে এলেন। রাস্তায় দেখলেন সারা দেশেই পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার চিহ্ন।
বাড়িতে মায়ের সাথে দেখা করে পরদিনই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন। আসার সময় মাকে বলে আসেন, “ঈদে খরচ পাঠাব, কোনও চিন্তা করো না। আর তোমরা এখান থেকে কোথাও যেও না, আমি যেন ফিরে এসে এখানেই দেখি।”
হামিদুর রহমান যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে। বাড়ি থেকে বের হয়ে চৌগাছা ইপিআর এর ৪ নম্বর উইংয়ের একটা কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করলেন। একদিন লেবুতলা অপারেশনে যাবার সময় হামিদুরকে সঙ্গে নেয়া হলো। লেবুতলা চৌগাছা থেকে আট মাইল দূরে। সেই অপারেশনে সাহসের সাথে যুদ্ধ করলেন টিনেজার হামিদুর। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় পঞ্চাশজনের মতো সৈন্য নিহত হয় সেদিন। সেই সময় ‘সি’ কোম্পানির দায়িত্ব দেয়া হয় লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম চৌধুরীকে। তিনিও বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সফলভাবে পরিচালনা করেন। ২১ সেপ্টেম্বর এই কোম্পানি রৌমারী-কোদালকাঠি সীমান্তে অবস্থান নেয়। এর কাছেই হানাদার বাহিনীর অবস্থান। তারা ভারি অস্ত্রসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে। সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে হামিদুর সবার আগে এগিয়ে গেলেন। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তাকে দেখে অনেকের মনোবল বেড়ে গেল এবং পাকবাহিনিকে পিঁছু হটতে বাধ্য করল। এতে করে হামিদুরের সাহসিকতার পরিচয় সবার সামনে উন্মোচিত হলো এবং কমান্ডারসহ সবাই তাকে বাহবা দিতে থাকলেন। হামিদুর রহমান বিষ্ময়বালক হিসেবে সবার সামনে পরিচিত হলেন। ‘সি’ কোম্পানির এক দুর্ধর্ষ সৈনিকরূপে আত্মপ্রকাশ করলেন তিনি।
তৎকালীন সিলেট জেলার মৌলভীবাজার মহকুমার (বর্তমানে জেলা) শ্রীমঙ্গল থানার ধলই চা বাগানের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত ধলই বর্ডার আউটপোস্ট (বিওপি)। ধলই নদী তীরবর্তী এই চা বাগানটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শেষ সীমায় অবস্থ্তি। সেখানে ছিল ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট) ক্যাম্প। যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানি সেনারা এই ক্যাম্পে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। এই ঘাঁটি অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। এখানে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বিরাট বহর এবং মজুদ অস্ত্রশস্ত্র। কাজেই অবস্থানগত এবং সামরিক দিক দিয়ে ধলই চা বাগানটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে মুক্তিবাহিনির কাছে প্রতীয়মান হয়। আর তাই মুক্তিবাহিনীর সামরিক অফিসাররা এই বাগান আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে নিজেদের দখলে নেবার পরিকল্পনা করেন। মুক্তিবাহিনীর জওয়ানরা অনেক উদ্যোগ নিয়েও তা দখল করতে পারেনি। ধলই চা বাগান থেকে ভারতীয় সীমান্ত প্রায় এক কিলোমিটার। ওপারে ভারতীয় ভূখণ্ড এবং ভারতের একটি সীমান্ত চৌকির কাছেই মুক্তিবাহিনীর কমলপুর সাবসেক্টর ক্যাম্প।
ধলই সীমান্তে একটু দূরে দূরেই প্রায় শখানেক বাংকার তৈরি করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। সেখানে অসংখ্য মা-বোনদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। এর মধ্যে দুটি বাংকার এখনও বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) যত্ন করে সংরক্ষণ করে রেখেছে।
প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট তখন মেজর (পরবর্তীতে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি) জিয়াউর রহমানের ‘জেড ফোর্সের’ অধীনে। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নে চারটি কোম্পানি ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’ ও ‘ডি’ কোম্পানি। ‘সি’ কোম্পানির ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয় ধলাই অপারেশনের। দীর্ঘ পাঁচদিন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে ধলই চা বাগানে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩০ তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের প্রায় দুই কোম্পানি সৈন্য (প্রায় ২০০জন) নিহত হয় এবং বহু সৈন্য আহত হয়।
১২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত দলটির নেতৃত্ব দেয়া হয় লে. আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরীকে। অনেক চিন্তা-ভাবনা পরিকল্পনার পর ঠিক হলো ২৮ অক্টোবর ধলই চা বাগানে আক্রমণ রচনা করা হবে। ২৭ অক্টোবর রাতের খাবার খেয়ে দশটার পর মুক্তিযোদ্ধারা রওয়ানা হলেন। সামনে নিয়মিত বাহিনী, পেছনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট বাহিনী। এই বাহিনীর নেতৃত্বে কমলপুরের সহকারী ক্যাম্প কমান্ডার সাজ্জাদুর রহমান। পাকিস্তানিদের অবস্থানের প্রায় ৬০০ গজ দূরে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের উদ্দেশ্যে সমবেত হন।
শত্রুর কাছাকাছি পৌঁছালেও ঘন কুয়াশায় চারদিক আচ্ছাদিত থাকায় আক্রমণ শুরু করা সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম হাবিলদার মকবুলকে একটি গাছের ওপর উঠে শত্রুর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতে বললেন। মকবুল গাছে চড়ে পরখ করতে গেলেন। তখন পাকিস্তানি বাহিনীও ক্যাম্প থেকে তাকে দেখে ফেলে। ফলে মকবুল গাছ থেকে নামতেই হঠাৎ করে পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ শুরু করে। প্রচণ্ড গোলার আঘাতে চারদিকে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ডিফেন্স নিয়ে অধিনায়ক কাইয়ুম ওয়্যারলেসে গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য চাইলেন, যাতে শত্রুর লক্ষ বদল হতে পারে। গোলন্দাজ বাহিনী সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে শত্রু অবস্থানের ওপর কামানের গোলা নিক্ষেপ করল। এর ফলে শত্রুঘাঁটিতে আগুন ধরে যায়।
এদিকে লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম একপ্লাটুন ডানে, একপ্লাটুন পেছনে এবং একপ্লাটুন বামে সাজিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলেন। শত্রুপক্ষের গুলিবর্ষণ থেমে যেতেই ঘাঁটির ওপর চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু হলো। শত্রুরাও মরণপণ প্রতিআক্রমণ করতে লাগল। তারা আগেই ভূমি মাইন পুঁতে রেখেছিল। মাইনের বিস্ফোরণের আঘাতে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। মুক্তিযোদ্ধারা দমে না গিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাপিয়ে পড়লেন। প্রাণের মায়া তুচ্ছ। কিন্তু একেবারে কাছে গিয়েও তারা ঘাঁটি দখল করতে পারছেন না। ঘাঁটির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি এলএমজি পোস্ট থেকে অনবরত গোলা আসছে। সেই মেশিনগান নিষ্ক্রিয় করতে না পারলে চূড়ান্ত বিজয় সম্ভব হবে না।
তখন ২৮ অক্টোবরের বেলা সাড়ে ৩টা কি ৪টা। অধিনায়ক কাইয়ুম হামিদুর রহমানকে ডেকে বললেন-ওই এলএমজিটা থামাতে হবে। অদম্য সাহসী বীর হামিদুর বুকে হেঁটে ক্রলিং করে শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়ে মেশিনগান পোস্টটির কাছে পৌঁছে গেলেন। হামিদুর বুকে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছেন। তার সামনে, পেছনে, ডানে বাঁয়ে, মাথার ওপর দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুটছে। তিনি ভয় পাচ্ছেন না। তার একমাত্র লক্ষ্য ওই এলএমজি পোস্টে পৌঁছানো। নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি তার মনোবলকে দমাতে পারছে না।
পাহাড়ি খালের মধ্যদিয়ে বুকে হেঁটে গ্রেনেড নিয়ে আক্রমণ শুরু করলেন তিনি। দুটি গ্রেনেড এলএমজি পোস্টে আঘাত হানে। এক পর্যায়ে তিনিও গুলিবিদ্ধ হন। কিন্তু নিজের দিকে খেয়াল দেবার তার এতোটুকুও সময় নেই। লক্ষ একটাই, এলএমজি পোস্ট। আরও একটু কাছে গিয়ে পোস্টের পিছনে থাকা পাকবাহিনীর দুইজন সৈনিকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। হাতাহাতি যুদ্ধের বদৌলতে এলএমজি থেকে গোলাবর্ষণ বন্ধ হয়ে গেল। সেই সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে এসে সীমানা ফাঁড়িটি দখল করতে সমর্থ হন এবং এই দুইজন আহত পাকিস্তানি সৈন্যকে পাকড়াও করেন। এ সময় পাশের আরেকটি বাংকার থেকে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে। সেই গুলিতে হামিদুর রহমান শাহাদত বরণ করেন। কপালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তার এই সাহসী লড়াই সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। হামিদুর রহমানের লাশ মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন উদ্ধার করতে পারেননি। ৩ নভেম্বর ধলই মুক্ত হলে সহযোদ্ধারা হামিদুর রহমানের লাশ সীমান্তের অল্পদূরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আমবাসা (হাতিমেরছড়া) গ্রামে স্থানীয় এক পরিবারের পারিবারিবারিক কবরস্থানে দাফন করেন। নিচু স্থানে অবস্থিত কবরটি এক সময় পানির তলায় তলিয়ে যায়।
দেশ স্বাধীনের প্রায় তিন যুগ পর ২০০৭ সালের ২৭ অক্টোবর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই অনুযায়ী ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাইফেলসের একটি দল ত্রিপুরা সীমান্তে হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহণ করে এবং যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে কুমিল্লার বিবিরহাট সীমান্ত দিয়ে শহীদের দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। পরদিন ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানকে রাজধানী ঢাকার মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পুনঃ সমাহিত করা হয়।
তার কীর্তির প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ও স্মৃতি স্মরণে নিজের গ্রাম ‘খোরদা খালিশপুর’-এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘হামিদনগর’। এই গ্রামে তার নামে রয়েছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। হামিদনগরে তার নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজ মাঠে নির্মাণ করা হয়েছে ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার’। গ্রন্থাগারে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রায় আড়াই হাজার বই। ঝিনাইদহ সদরে তার নামে রয়েছে একটি স্টেডিয়াম। একটি ফেরিও তার নামে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ তার স্মরনে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। ২০১৬ সালে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের (টিএসসিসি) নাম পরিবর্তন করে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে ‘বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান কেন্দ্রীয় মিলনায়তন’ নামকরণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের পৈত্রিক ভিটায় একটি পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছে। এ নির্ভীক অকুতোভয় বীর সৈনিক এদেশের মানুষের হৃদয়ে চির জাগরুক হয়ে থাকবেন।
তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়; বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর; বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, খুলনা বিভাগ, ঝিনাইদহ জেলা, ২৬ অক্টোবর ২০২২; একাত্তরের বীরযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জীবনগাঁথা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা স্মারকগ্রন্থ, জনতা ব্যাংক লিমিটেড, মতিঝিল-ঢাকা, জুন ২০১২, পৃষ্ঠা ৩২; বিভিন্ন গণমাধ্যম।

শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved 2018 shilonbangla.com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com