সোমবার, ২৯ মে ২০২৩, ০২:৩৩ পূর্বাহ্ন

ললিতকলার সেই শিক্ষক রাহিজা খানম ঝুনু

ললিতকলার সেই শিক্ষক রাহিজা খানম ঝুনু

গুণীজন

নৃত্যগুরু রাহিজা খানম ঝুনু ১৯৪৩ সালের ২১ জুন বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলায় এক শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন

সাদ বিন ওয়াহেদ

রাহিজা খানম ঝুনু। একজন প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যশিক্ষক। তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে (বাফা) নৃত্যশিক্ষক এবং বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ‘নৃত্যগুরু’ হিসেবে পরিচিত ও সম্মানিত ছিলেন। পাকিস্তান আমলে পায়ে নূপুর জড়িয়ে ভেঙ্গেছিলেন অচলায়তন। অবরোধবাসিনীর জীবনকে উপেক্ষা করে হয়েছিলেন নৃত্যশিল্পী। হয়েছেন দেশের নৃত্যশিল্পের পথের দিশারী। দেশের খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে লায়লা হাসান, জিনাত বরকত উল্লাহ, কাজল ইব্রাহীম, লুবনা মারিয়াম, শামীম আরা নীপা, তারানা হালিম, দীপা খন্দকার, সোহেল রহমান, কবিরুল ইসলাম রতন, আবদুর রশিদ স্বপন, আনিসুল ইসলাম হিরুসহ অনেকে তার ছাত্র।

নৃত্যকলায় অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৯০ সালে রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মানন ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করে। রাহিজা খানম কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬১ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর নৃত্যকলা বিভাগে সর্বোচ্চ নম্বর এবং শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী হিসেবে স্বর্ণপদক ছাড়াও বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরী পদক লাভ করেন। তিনি বাংলা একাডেমিরর সম্মানসূচক ফেলোশিপও অর্জন করেন। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ‘আরটিভি পন্ডস আলোকিত নারী’ সম্মাননা পান তিনি। ‘নৃত্যশিল্প’ ও ‘নৃত্যের রূপরেখা’ নামে তার দুটো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

ঝুনু ১৯৪৩ সালের ২১ জুন বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলায় এক শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবু মোহাম্মদ আবদুল্লাহ খান ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার এবং মাতা সফরুন নেছা। ঝুনু ছোটবেলায় কলের গান বাজিয়ে বাড়িতে নাচতেন। তার বাবা এতে খুশি হয়ে তাকে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া বালিকা বিদ্যালয়ে (মনিজা রহমান গার্লস স্কুল) ভর্তি করান। যেখানে তিনি পড়াশুনার পাশাপাশি নাচ ও গান শিখেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষিক বাসন্তী গুহঠাকুরতা প্রতি বছর স্কুলে নাচ ও গানে প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সময়কালে শহিদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার স্ত্রী। ১৯৫৫ সালে ঝুনু পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন বাসন্তী গুহ ‘ঘুমন্ত রাজকন্যা’ নামে একটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেন। এতে ঝুনু একটি পুরুষ চরিত্রে নাচে অংশগ্রহণ করেন। এই নৃত্যনাট্যের নৃত্য পরিচালক ছিলেন অজিত স্যান্যাল। তিনি ঝুনুর পিতাকে বলেন তাকে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি করতে। ১৯৫৬ সালে ঝুনু নৃত্যে তালিম নিতে বাফায় ভর্তি হন। তিনি ছিলেন বাফার প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তার সাথে তার ভাই মোজাম্মেল হোসেন সেতার, বোন রুনু রবীন্দ্র সঙ্গীত এবং নীনা ধ্রুপদী সংগীত বিভাগে ভর্তি হন।

ঝুনু বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি হওয়ার পর বেশ কয়েকটি নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করেন। বাফায় ভর্তির পরের বছর ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি বাফার নিউ পিকচার হাউসে মঞ্চস্থ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্য ‘চন্ডালিকা’য় চুড়িওয়ালা চরিত্রে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে জি এ মান্নান বাফায় নৃত্যশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নেন। ঝুনু এই নৃত্যনাট্যে সাজু চরিত্রে এবং জি এ মান্নান রূপাই চরিত্রে অংশগ্রহণ করেন। তিনমাস ব্যাপী অনুশীলনের পর নৃত্যনাট্যটি ইস্কান্দার মির্জা হলে (বর্তমানে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন) মঞ্চস্থ হলে এর পরিচালক এবং অংশগ্রহণকারীদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তারা পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শহর, ইরাক ও ইরানে এই নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করে। ইরানে ঝুনুর কাজ ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নৃত্যশিল্পী হিসেবে হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে কিংবদন্তীতে পরিণত হন তিনি।

১৯৬০ সালে রাহিজা খানম ঝুনু রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন। বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকে ১৯৬১ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি সার্টিফিকেট কোর্সে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি বাফার নৃত্যশিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৯৮ সালে অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঝুনু এসময়ে বেশ কিছু নৃত্যনাট্য পরিচালনা করেন এবং অংশগ্রহণ করেন। ড. এনামুল হক রচিত ‘সূর্যমুখী নদী’, ‘উত্তরণের দেশে’, ‘হাজার তারের বীণা’ নৃত্যনাট্যসমূহ পরিচালনা ও অংশগ্রহণ করেছেন। উত্তরণের দেশে নৃত্যনাট্যটি একুশে ফেব্রুয়ারির ওপর ভিত্তি করে রচিত এবং সূর্যমুখী নদী গীতিনৃত্যনাট্যটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত। তিনি শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনায় ‘দ্য মেলোডি’ নৃত্যনাট্য পরিচালনা করেন। শিশুদের জীবনভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ নৃত্যনাট্য দেখব এবার জগৎটাকে পরিচালনা করেছেন।

১৯৬৬ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি ঝুনু আমান উল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আমান উল্লাহ ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে তিন বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তাদের দুই মেয়ে লোপা ও ফারহানা চৌধুরী বেবী দুজনেই লোক ও আধুনিক ধারার নৃত্যশিল্পী। লোপা ১৯৯০ সালে হঠাৎ মারা যান। এছাড়া তাদের দুই ছেলে আহসান উল্লাহ চৌধুরী ও আকরাম উল্লাহ চৌধুরী।

ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস ও হৃদরোগে আক্রান্ত ঝুনু ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রাজধানীর বেসরকারি ল্যাব এইড হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় চুয়াত্তর বছর বয়সে ২৬ নভেম্বর সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে তিনি এই হাসপাতালেই ইন্তিকাল করেন। তাকে ময়মনসিংহের ভালুকাবাজার বড় মসজিদের সংলগ্ন কবরস্থানে স্বামীর কবরের পাশে সমাহিত করা হয়েছে।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া; ‘নৃত্যগুরু রাহিজা খানম ঝুনু আর নেই’, দৈনিক প্রথম আলো, ২৬ নভেম্বর ২০১৭; ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য মঞ্চায়ন’, দৈনিক জনকণ্ঠ, ৩১ জুলাই ২০১৫; ‘চলে গেলেন নৃত্যগুরু রাহিজা খানম ঝুনু’, দৈনিক মানবজমিন, ২৭ নভেম্বর ২০১৭; ‘বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপপ্রাপ্ত বিশিষ্টজনের তালিকা’, বাংলা একাডেমি, ১ আগস্ট ২০১৭।)

শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved 2018 shilonbangla.com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com