গুণীজন
সাদ বিন ওয়াহেদ
প্রবোধচন্দ্র গুহ। ভারতীয় বাংলা রঙ্গমঞ্চের অন্যতম পরিচালক, প্রযোজক ও অভিনেতা। প্রবোধচন্দ্র গুহের জন্ম ১৮৮৫ সালে, বৃটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের বরিশালের বানারীপাড়ায়। শিক্ষান্তে কলকাতায় সরকারি চাকরি করতেন। তবে নাট্যামোদী তিনি কলকাতার ‘আর্ট থিয়েটার’ এর সাথে যুক্ত ছিলেন। ‘আর্ট থিয়েটার’ স্টার থিয়েটারের পরিচালনভার গ্রহণ করলে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্টার থিয়েটারের সেক্রেটারির পদ গ্রহণ করেন। ১৯২৩ সালে প্রথম নাটক অপরেশচন্দ্র রচিত নাটক ‘কর্ণার্জুন’ প্রথম মঞ্চস্থ করে আর্ট থিয়েটার প্রবোধচন্দ্রের তত্ত্বাবধানে। এবং অত্যন্ত জনপ্রিয়তার কারণে নাটকটি দুইশ’ রজনী অভিনীত হয়েছিল। পরে তিনি মনোমোহন থিয়েটারে আসেন।
১৯৩১ সালের ১৪ মার্চ (১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ৩০ ফাল্গুন) তিনি নিজস্ব রঙ্গালয় ‘নাট্য নিকেতন’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার আমন্ত্রণে নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরী যোগ দেন। নাট্যনিকেতনের তখন উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা ছিল -‘মুক্তির উপায়’, ‘মা’, ‘পথের দাবি’, ‘চরিত্রহীন’,‘সিরাজদ্দৌল্লা (১৯৩৮)’, ‘আলেয়া’, ‘কারাগার (১৯৩০)’ ও ‘কালিন্দী’।
প্রতিষ্ঠার বছরেই নাট্যনিকেতনে পাঁচটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। এর মধ্যে প্রথম নাটকটি ছিল ‘ধ্রুবতারা’, উদ্বোধনী দিনে মঞ্চস্থ হয়। যতীন্দ্রমোহন সিংহের উপন্যাস অবলম্বনে নাট্যরূপ দিয়েছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। নাটকটিতে দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহৃত হয়েছিল। অবশিষ্ট গানগুলো সুর দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। অভিনয় করেছিলেন নির্মেলন্দু লাহিড়ী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, নীহারবালা প্রমুখ।
দ্বিতীয়টি ছিল মন্মথ রায়ের রচিত নাটক ‘সাবিত্রী’। ৩০ মে মঞ্চস্থ এই নাটকের সঙ্গীত রচয়িতা এবং সুরকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এরপর ‘কারাগার’। ৮ আগষ্ট (শনিবার, ২৩ শ্রাবণ ১৩৩৮)। মন্মথ রায়ের রচিত নাটক। এই নাটকটি প্রথম অভিনীত হয়েছিল ১৯৩০ সালের ২৪ ডিসেম্বর। ১৮টি অভিনয়ের পর, ব্রিটিশ সরকার নাটকটির অভিনয় বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে, নাট্যনিকেতনে অভিনীত হয়। ‘ঝড়ের রাতে’ ছিল নাট্যনিকেতনের তৃতীয় পরিবেশনা। শচীন সেনগুপ্তের রচিত নাটকটির পরিচালক ছিলেন সতু সেন। এছাড়া ‘আলেয়া (গীতিনাট্য)’ মঞ্চস্থ হয় ১৯৩১ সালের ১৯ ডিসেম্বর। কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচিত গীতিনাট্য। নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন সতু সেন। বিভিন্ন চরিত্র রূপায়ণ করেছিলেন- ধীরাজ ভট্টাচার্য, ভূপেন রায়, নিরূপমা দেবী, তারাসুন্দরী প্রমুখ।
অহীন্দ্র চৌধুরী ছাড়াও তার প্রযোজিত বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করেছেন তিনকড়ি চক্রবর্তী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, নীহারবালা প্রমুখ। রানিবালা ও সরযূদেবী নাট্যনিকেতনেই অভিনেত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পান। নাট্যকার শচীন সেনগুপ্ত ও মন্মথ রায় প্রবোধচন্দ্রের সংস্পর্শে এসে তারা প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পান। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর প্রবোধচন্দ্র কিছুকাল পাকিস্তানে বাস করার সময় সিনেমা শিল্পে আত্মনিয়োগ করেন। এক সময় তিনি পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাংকের অন্যতম পরিচালকও হয়েছিলেন। ১৯৩১ সালে তার প্রতিষ্ঠিত নাট্যনিকেতনই পরে ১৯৪২ সালে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর হয় ‘শ্রীরঙ্গম’। ১৪ বছর পর ১৯৫৬ সালে অর্থাভাবে শ্রীরঙ্গমও বন্ধ হয়ে যায়। এটিই বর্তমানে ‘বিশ্বরূপা থিয়েটার’।
কবি নজরুলের সাথে তার সখ্যতা ছিল। ১৯২৫ সালের ১৩ জানুয়ারি কাজী নজরুল ইসলাম মেদিনীপুরের তমলুকে স্বদেশী মেলা উদ্বোধনকালে সঙ্গে ছিলেন প্রবোধচন্দ্র গুহ।
এ গুণী নাট্যব্যক্তিত্ব ১৯৬৯ সালের ২ জুলাই পরলোক গমন করেন।
(তথ্যসূত্র : বরিশালপিডিয়া; সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ৪১৪।)
Leave a Reply