নিয়ন মতিয়ুল : জন্মদিন নিয়ে বরাবরই বিব্রত আমি। পৃথিবীতে আগমনের ক্ষণটি নিয়েও তেমন আগ্রহ নেই। তবে তীব্র তুমুল প্রতিক্রিয়া আছে আমার মায়ের জন্য। উত্তরজনপদের ভয়াল শীতের এক রাতে মায়ের সীমাহীন কষ্টের ফসল আমি। অনেকবার গল্পের ছলে বোঝার চেষ্টা করেছি সেদিনের সেই মুহূর্তে কতটা যন্ত্রণাকাতর ছিলেন আমার মা। দশ মাস দশদিন গর্ভে ধারণ করার পর পৃথিবীর আলো দেখানো, আগলে রাখা, নিরাপত্তা দেয়া, চলতে বলতে শেখানো- কত দিন মাস বছর যে কেটে গেছে আমার মায়ের! মাঝে মাঝে ভাবি, কী প্রয়োজন ছিল আমার পৃথিবীতে আসার? আমার আগমনটা না ঘটলে মায়ের সেই ভয়াল রাতের যন্ত্রণাটা অন্তত হতো না! আর এলামই যখন, আমার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আশ্রয় সেই মাকে কতটা দিতে পেরেছি- সম্মান, শ্রদ্ধা, নিরাপত্তা?
আমার জীবনের সব নেতিবাচকতাকে সীমাহীন ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করা জীবনসঙ্গী যখন সেই মাকে পাশে নিয়ে আমার ভূমিষ্ট দিবসের কেক কাটে তখন বিব্রত না হয়ে পারি না। এই মা-ই সারাজীবন আমার আব্বার দাপুটে মেজাজ সহ্য করে সংসার আকড়ে পড়েছিলেন- শুধু তার সন্তানদের জন্য। আর আমার সেই জীবনসঙ্গী প্রায়ই রাজপথে দাঁড়ান পুরুষদের নিপীড়ন প্রবণতা, কামুকতা আর লাম্পট্যপনার বিরুদ্ধে (#মিটু)। প্রবল পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সম্মান, আত্মমর্যাদা আর সমমাত্রার অধিকার আদায়ের জন্য। এই দুজন ব্যক্তির দিকে তাকালে আমার লজ্জা হয়, বিব্রত বোধ করি। সেসব পুরুষের জন্য লজ্জিত হই যারা নারীদের বিচার করেন শরীর আর যৌনতার মাপকাঠিতে! ধর্মীয় নির্দেশনার অপব্যাখ্যায় যৌন নিপীড়নের উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করেন।
আমি বিশ্বাস করি, সভ্যতা মানে উন্নত মনন, সুরুচি সম্পন্ন সমাজ। বন্যতা নয়, শিল্পসম্মত যৌনতাই সভ্যতার পরিচায়ক হওয়া উচিত। কিন্তু আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি সভ্যতা আজ একটা প্রহসন। এখানে অসভ্যরা পৃথিবীকে নোংরা আবর্জনায় পরিপূর্ণ করার নেশায় উন্মত্ত। আর সভ্যরা প্রতিমুহূর্তে সে আবর্জনা পরিষ্কার করে যাচ্ছে নীরবে, নিভৃতে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, চারপাশটা ঘিরে তীব্র তুমুল অন্ধকার। সে অন্ধকারে আমি হেঁটে যাচ্ছি মহাকালের দিকে। যেখানে হিংসা, বিদ্বেষ, ভোগ, স্বপ্ন, সম্ভাবনা- শূন্যতায় এসে বিলীন হয়। পৃথিবীটা হয়ে উঠুক প্রতিটি নারীর জন্য নিরাপদ, স্বপ্ন-সম্ভাবনাময়। চারপাশের সমাজটা হয়ে উঠুক প্রবলরকম নারীবান্ধব- তাহলেই আমার মা আর জীবনসঙ্গীর কাছে হয়ে উঠতে পারতাম নিঃসঙ্কোচ, দ্বিধাহীন।
(বিদ্র: তিনি’র আয়োজন করা আমার ভূমিষ্ট দিবস সংক্রান্ত তার ফেবু পোস্টে যারা শুভেচ্ছায় আমাকে ভরিয়ে দিয়েছেন সেসব শুভাকাঙ্ক্ষির প্রতি আমার সীমাহীন কৃতজ্ঞতা। আপনাদের ভালোবাসা আমার কাছে অক্সিজেনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ভালো থাকুন সব স্বজন-প্রিয়জন।)
লেখক : সাংবাদিক
Leave a Reply