শনিবার, ২৭ মে ২০২৩, ১২:৩৩ অপরাহ্ন

ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে তৃতীয় লিঙ্গের নীলা-আঁখিরা কাজ করে খায়

ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে তৃতীয় লিঙ্গের নীলা-আঁখিরা কাজ করে খায়

ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে তৃতীয় লিঙ্গের নীলা-আঁখিরা কাজ করে খায়

শীলনবাংলা ডটকম : ঢাকার অদূরে সাভারে অবস্থিত বেসরকারি গণ বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে যেয়ে দাড়াতেই এক চিৎকার কানে এসে লাগলো ‘আইডি কার্ড গলার মধ্যে ঝুলিয়ে নিন, আইডি কার্ড ছাড়া কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হবে না’। তাকিয়ে দেখি এক হিজড়া (আমাদের ভাষায়) আর সরকার যাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের। রাস্তার এপার থেকে তাকিয়ে দেখি সে একা নয় আরো দু’জন আছে তার মত তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য। এই দৃশ্য দেখে খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম। অবাক হলেও খুব ভালো লাগছিলো এই দৃশ্যটি দেখতে। কারণ আমরা যারা এই শহরে পথ চলি আমরা শুধু একটি ছবি দেখে অভ্যস্ত যে, হিজড়ারা চলন্ত বাসে উঠে বা দোকানে দোকানে ঘুরে ভিক্ষা করছে। কিন্তু এই ঘটনাটি তার একদম ব্যাতিক্রম।

তৎক্ষণাত মনটা চাচ্ছিলো তাদের সাথে গিয়ে কথা বলি কিন্তু হালকা সঙ্কোচ বোধও কাজ করছিলো। পরে যেতে যেতে ভাবলাম, না! তাদের সাথে অবশ্যই কথা বলবো। সেই ভাবনা থেকে সাহস নিয়ে দুপুরের খাবার বিরতিতে খাবার খেয়ে সবাই যখন চায়ের আড্ডাতে ব্যাস্ত আমি তখন গেলাম তাদের সাথে কথা বলতে। সেখানে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তারা প্রথমে রাজি না হলেও প্রশাসনের অনুমতির পর হাসি মুখে রাজি হয় কথা বলার জন্য। আমি বললাম চলেন তাহলে একটু বসে কথা বলি? তাদের মধ্যে একজন বললো চলেন ওখানে বসি। প্রধান ফটকের পাশে এক ছোট চালার মত বসার স্থান। সেখানে বসেই কথা হলো তাদের সাথে প্রথমেই নাম দিয়ে শুরু করি। নাম জিজ্ঞাসা করতেই একজন বললো, আমি আঁখি সে নীলা আর ওর নাম সুমনা। কথায় কথায় নীলা বলেন, বাড়ি ছেড়েছি আজ প্রায় ২০ বছর। আমার গ্রামের বাড়ি যশোর জেলায়। ঢাকায় প্রথমে এসে অন্যদের মত দোকানে দোকানে ভিক্ষা করতাম। কিন্তু এসব করতে আমার ভালো লাগতো না। তাই আমি পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সবখানে শুধু অপমান আর লাঞ্চনার শিকার হয়েছি। সবাই আমাদের নিয়ে হাসি- তামাশা করতো। এখানে আসার আগে গার্মেন্টসে কাজ করতাম কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা স্বাধীনভাবে চলতে পারতাম না।

কিভাবে এখানে চাকরি পেলেন এমন প্রশ্নে আঁখি পাশ থেকে উত্তর দিলেন, আমরা সাভারের পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার হিজড়া দলের সদস্য ছিলাম। হঠাৎ করে একদিন আমাদের গুরু মা আমাদেরকে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষিকা সাকিনা আক্তার ম্যাডামের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি তৃতীয় লিঙ্গের মধ্যে যারা যৌন কর্মী তাদের জন্য কাজ করতেন। ম্যাডামই আমাদের এখানে এই চাকরি করার প্রস্তাব দেন, আর আমরাও রাজি হয়ে যাই। এরপর রেজিস্টার স্যার আমাদের ইন্টারভিউ নেয়ার পর চাকরিটা হয়। আঁখি ও সুমনা প্রায় ১০ বছর আগে বাড়ি থেকে চলে এসেছেন। আঁখির গ্রামের বাড়ি বরিশাল আর সুমনার টাঙ্গাইলে। ঢাকাতে কাজের মাধ্যমেই তাদের তিন জনের পরিচয় এবং বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আঁখি বলেন, আমরা যখন ভিক্ষা করতাম তখন পরিবারের বা গ্রামের সবাই আমাদের অবহেলা আর ঘৃণা করতো। কিন্তু এখন বাসার লোকসহ প্রতিবেশিরা আমাদের ভালবাসে উৎসাহ দেয়। বলে, তোমরা এবার ভালো কাজ করতেছো। আগে ভিক্ষা করে ত্রিশ হাজার টাকা আয় করতাম প্রতিমাসে। কিন্তু এখন কম পেলেও অনেক সম্মান পাই। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।

এরপর নীলা ও আঁখি দু’জনেই বলেন, এখন মাঝে মাঝেই মাকে দেখতে বাড়িতে যাই। প্রতিমাসে মাকে টাকা পাঠাই। এখন খুব ভালো লাগে। এখানে আমরা স্বাধীনভাবে চলতে পারি। আমাদের পছন্দ মত পোশাক পড়তে পারি, সাজতে পারি। কেউ কিছু বলে না। সুমনা চুপচাপ সব শুনছিলো। তাকে প্রশ্ন করতেই বললেন, আমার মা-বাবা বেঁচে নেই। গ্রামে ভাই-ভাবি ও তাদের ছেলে মেয়ে আছে, তাদের সাথে দেখা করতে যাই। গেলে সবাই অনেক খুশি হয়। নীলা যোগ করেন, এখন আমরা মাথা তুলে চলাফেরা করতে পারি। কারণ আমরা আর সবার মত পরিশ্রম করে খাই, কারো কাছে হাত পাতি না। আজকের এই অবস্থানের জন্য সাকিনা আক্তার ম্যাডাম, রেজিস্টার স্যারের কাছে আমরা ঋণী। ওনারা আমাদের সুযোগ না দিলে আমরা আজ এভাবে সম্মান নিয়ে চলতে পারতাম না। আমাদের ঐ ভিক্ষাই করতে হতো। আর রেজিস্টার স্যার আমাদের পিতার মত। ওনার কাছে আমরা সবকিছু খুলে বলতে পারি। যা আমরা আমাদের মা- বাবার কাছেও বলতে পারি না।

তৃতীয় লিঙ্গের নিরাপত্তাকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়কারী ইংরেজী বিভাগের শিক্ষিকা সাকিনা আক্তার বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো আমাদের সমাজে যেভাবে অবহেলিত ও অপমানিত হয়, তা সভ্য মানুষ হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। সমাজে আমরা শুধু তাদের তিরস্কারই করি, কিন্তু কখনো কোনো কাজের সুযোগ দেই না। কিন্তু এটা খুব সত্যি কথা যে, সুযোগ পেলে তারা আমাদের মতই কাজ করার যোগ্যতা রাখে।

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি রেজিস্টার আবু মোহাম্মদ মোকাম্মেল জানান, গত চার মাস ধরে তারা এখানে নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে কাজ করছে। তাদেরকে আমরা নিয়োগ দিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছি কিভাবে নিরাপত্তা এবং ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সাথে কি ধরণের আচরণ করতে হবে তা নিয়ে। তারপর থেকে তারা তাদের দায়িত্ব সফল ভাবেই পালন করছে। তারা এই চার মাসে যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। তারা খুব সৎ ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করছে। কোন প্রকার অবহেলা করেনি। তিনি আরো জানান, তাদের নিষ্ঠা দেখে আমাদের রেজিস্টার স্যার তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের এখানেই আরো ভালো কোন জায়গায় তাদের চাকরীর ব্যবস্থা করার কথা ভাবছেন। আর তাদের বেতন অন্য নারী-পুরুষ নিরাপত্তা কর্মী যারা আছেন তাদের থেকে বেশী এবং তারা এটার যোগ্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ যেন নিজেদেরকে সমাজের জন্য বোঝা মনে না করেন, তারা যেন আর দশজন সাধারণ মানুষের মত নিজেদের সকল কাজে নিয়োজিত করতে পারেন, সেই সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই আমাদের এই উদ্দ্যোগ। সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তথা এই হিজড়া জনগোষ্ঠীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছে সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা চাই তারা স্বাভাবিক ভাবে সাধারণ মানুষের মত এই সমাজে বসবাস করুক। তাই তাদের জন্য উচ্চতর শিক্ষার ব্যবস্থা করাসহ আমাদের এমন উদ্দ্যোগ অব্যাহত থাকবে বলেও জানান রেজিস্ট্রার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তকে দিন বদলের মাইলফলক হিসেবে দেখে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সচেতন মহল।
গ্রন্থনা : আবদুল্লাহ আল মামুন

শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved 2018 shilonbangla.com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com