আমিনুল ইসলাম কাসেমী
মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ, সত্যিকারের রাজনৈতিক লিডার ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে প্রকৃত রাজনৈতিক লিডারের ছাপ ছিল। একজন নেতার যেমন গুণাবলী থাকার দরকার, সবই ছিল তাঁর মধ্যে। চাল- চলনে, কথা – বার্তা, সাহসিকতায় তুখোড় নেতার চরিত্র ফুটে উঠত।
এখনতো সব ওয়ায়েজের ময়দানকে আমরা রাজনৈতিক মঞ্চ বানিয়ে ফেলেছি। ওয়াজ করতে গিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছি। ময়দানে যারা ওয়াজ শুনতে এসেছিল, তারাতো আর নির্বিঘ্নে এখন আর ওয়াজ শুনতে পারেনা। বক্তাদের খাম- খেয়ালীপনায় ওয়াজ মাহফিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুফতী আমিনী সাহেব ওয়াজ মাহফিলে বসে হুঙ্কার দেন নি। তিনি রাজনৈতিক মঞ্চে ওঠে বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেছেন। ওয়াজ মাহফিল গুলো নিরাপদে রেখেছেন।
এখনকার বহু রাজনৈতিক নেতাকে দেখি, বহু হুমকি- ধমকি দেন, কিন্তু কর্মিদের কোন খোঁজ নেন না। ওয়াজের ষ্টেজে বসে ময়দান গরম করেন। কিন্তু মঞ্চ থেকে নেমে বা মঞ্চে ওঠার আগে ওনাদের সাথে কর্মিরা কথা বলতে পারেন না। মনের কথাগুলো শোনার সময় হয় না।
মুফতী আমিনী এমন লিডার ছিলেন, তিনি যেখানে যেতেন, নেতা- কর্মিদের খোজঁ নিতেন। তাদের মনের কথাগুলো শুনতেন। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন।
কোন এলাকায় সফরে গেলে স্হানীয় আলেম- উলামার সাথে সাক্ষাত করতেন। হাত মেলাতেন। তাদের সাথে বসে খানা খেতেন। তারা কেউ না আসলে খোঁজ নিতেন, কোথায় তাঁরা?
মুফতী আমিনীকে ফরিদপুরে কাছে পেয়েছি বহুবার। ফরিদপুরে তাঁর দলের আস্হাভাজন লিডার ছিলেন, মুফতী আব্দুল কাদের রহ, মাওলানা খলিলুর রহমান রহ, হাজী ফারুক রহ, এবং মুফতী মাহমুদ হাসান ফায়েক দামাতবারাকাতুহুম ও মাওলানা আহমাদ মাসরুর সাহেব দামাতবারাকাতুহুম ।
ফরিদপুরের যে কোন প্রোগ্রামে এই মানুষগুলোকে তিনি সব সময় কাছে রাখতেন। বৃহত্তর ফরিদপুরের যে কোন জায়গায় উক্ত নেতাগুলো তাঁকে ছায়ারমত অনুসরণ করেছে। কোন জায়গায় উনাদের না পেলে মুফতী আমিনী সাহেব বারবার তাদের কথা বলতেন।
মানে লিডার তো লিডার। তিনি নিজেকে একাকী কিছু ভাবেন নি। জনতাকে নিয়ে, দলের নেতা কর্মিকে নিয়ে তিনি ভেবেছেন।
আমাদের রাজবাড়ীতে বেশ কয়েকবার তিনি এসেছিলেন। এ যেন মাটির মানুষ। যেখানে রাত সেখানে কাত। বহু লম্বা সফর। সফর সঙ্গী খাদেমগণ চেয়েছেন, কিছু একটা বিশ্রাম করুক তিনি। কিন্তু নেতা- কর্মি পরিবেষ্টিত সব সময়।
স্পেশাল রুম বা স্পেশাল খাবারের জন্য তাঁর কোন দাবী – দাওয়া থাকত না। যে এলাকায় গিয়েছেন, সেখানকার নেতা কর্মিদের সাথে নিয়ে খানা খেয়েছেন।
আমাদের মাদ্রাসাতে কয়েকবার এসেছেন। কোন হাঁক- ডাক নয়। সাধাসিধে ভাবে। মাদ্রাসার পুকুর ঘাটে বসে নেতা কর্মিদের সাথে গল্প জুড়ে দিলেন। সকলের সুবিধা- অসুবিধার কথা শুনলেন। অল্প সময়ে যেন মজলিসটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠল।
ওয়াজ মাহফিল করে গেলেন, কিন্তু কোন হাদিয়ার গল্প ছিল না। কেউ এসে বলল না, হুজুরকে এত এত টাকা দিতে হবে। বা এই সব- এই সব ব্যবস্হা থাকতে হবে।
আহ, কত ফর্মালিটি এখন। বক্তা আসার আগে কত প্রকার লোক যে এখন আসে। গোপনে একজন শুনায়ে যায়, এত্ত টাকা কিন্তু হুজুরকে দিবেন। হুজুর কিন্তু চায় না, তবে এত্ত এত্ত দিতে হয়। আবার আরেকজন এসে বলে, হুজুর কিন্তু ওটা খায় না, ওটা খায় না। আবার আরেকজন বলে, এ্যাটাষ্ট বাথ রুম কই? এ্যাটাষ্ট বাথরুম ছাড়া হুজুর কিন্তু আসবেনা।
আবার আজকাল তো এসি খোঁজা শুরু হয়ে গেছে। আবার হাদিয়ার টাকা কম হলে আর ভবিষ্যতে পাওয়া যায় না। এক বছরই শেষ!
বড় আফসোস লাগে বর্তমানের ওয়ায়েজ এবং নেতাদের অবস্হা দেখে। দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য কাজ করা লোক এখন কম। খুবই কম দেখাচ্ছে এখন। বিশেষ করে যারা ওয়াজ করতে করতে এখন নেতা হয়েছেন, এদের রাজনৈতিক গিলু নেই বললে চলে। ওনাদের সেই শায়েখানা ভাব এখনো কাটেনি। এখনো তাঁরা রাজনৈতিক ময়দানে অপরিপক্ক। নিজের ইচ্ছেধীন সব কিছু করেন। আচার- ব্যবহার এখনো ঠিক হয়নি।
এজন্য মুফতী আমিনী সাহেবের মত নেতা এখনো বে-মেছাল। তাঁর মতের সাথে হয়ত অনেকের অমিল ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সকলে একমত হতে পারেন নি। কিন্তু তিনি লিডার হিসেবে যোগ্য ছিলেন, সেটা কিন্তু সবাই শিকার করবে। তাঁর আমল – আখলাক চারিত্রিক গুণাবলী ছিল অনেক ঊর্ধ্বের। প্রারম্ভিক জীবন: মুফতী আমিনী সাহেব ১৯৪৫ সালে ব্রাম্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল থানার আমীনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রাথমিক শিক্ষা মায়ের কাছে। এরপর নিজ জেলার জামেয়া ইউনুসিয়াতে। তারপর মুন্সিগন্জ জেলার মোস্তফাগন্জ মাদ্রাসায় তিন বছর লেখাপড়া করেন। ১৯৬১ সনে তিনি ঢাকা লালবাগ জামেয়া কুরআনিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ে হাদীস পাশ করেন। ১৯৬৯ সনে তিনি করাচির নিউ টাউন মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং উলুমুল হাদীসের উপর বিশেষ ডিগ্রি অর্জন করেন।
মুফতী আমিনী সাহেবের উল্লেখযোগ্য উস্তাদঃ
১/ মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ,
২/ মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ,
৩/ মাওলানা আব্দুল ওহাব পীরজি হুজুর রহ,
৪/ শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ,
কর্ম জীবন : পাকিস্তান থেকে লেখাপড়া শেষ করে দেশে আসার পর ১৯৭০ সনে ঢাকার কামরাঙ্গীর চর নুরিয়া মাদ্রাসাতে তাঁর কর্ম জীবন শুরু হয়। ১৯৭৫ সনে তিনি জামেয়া কুরআনিয়া লালবাগ মাদ্রাসায় যোগদান করেন। এবং ১৯৮৭ সনে হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর তিনি লালবাগ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এছাড়া বড় কাটরা মাদ্রাসা সহ বহু প্রতিষ্ঠানের মুরুব্বী হিসেবে ছিলেন।
রাজনৈতিক জীবন : হাফেজ্জী হুজুরের খেলাফত আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে তিনি সক্রিয় ছিলেন। এরপর সভাপতি ছিলেন ইসলামী ঐক্য জোটের। তাছাড়া কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলন, নাস্তিক – মুরতাদ বিরোধী আন্দোলন, সকল যুগপৎ আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছেন।
২০০১ সনের জাতীয় নির্বাচনে তিনি ব্রাম্মণবাড়িয়া -২ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচিত হন।
একজন আলেম হিসেবে মহান জাতীয় সংসদে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদের মতই তিনি সংসদে অবদান রেখেছিলেন।
সন্তান – সন্ততি : আমিনী সাহেবের দুই ছেলে ও চার মেয়ে। তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুরের জামাতা ছিলেন।
বর্তমানে আমিনী সাহেবের ছেলে আবুল হাসনাত আমিনী পিতার অবর্তমানে রাজনীতি করে যাচ্ছেন।
ইন্তেকাল : ২০১২ সনের ১২ ডিসেম্বর মুফতী আমিনী সাহেব ৬৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। মুফতী ফজলুল হক আমিনী এদেশের উলামায়েকেরামের উজ্জল নক্ষত্র ছিলেন। ইসলামী রাজনীতির এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তিনি ২০০১ সনে হাইকোর্টের ফতোয়া বিরোধী রায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন । তিনি সে সময়ে কারাবরণ করে ছিলেন। পুরো দেশব্যাপি তাঁর পক্ষে জনমত তৈরী হয়েছিল। মুফতী আমিনী সাহেবের জন্য দুআ রইল। আল্লাহ তাঁকে জান্নাত দান করুন। আমিন।
লেখক : কওমি মাদরাসার শিক্ষক
Leave a Reply