শনিবার, ২৭ মে ২০২৩, ০২:০৫ অপরাহ্ন

বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ সৈয়দ শামসুল হক

বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ সৈয়দ শামসুল হক

গুণীজন

বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ সৈয়দ শামসুল হক

এ ‘সব্যসাচী লেখক’ ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর (১৪২৩ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন) ঢাকার বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন

সাদ বিন ওয়াহেদ

সৈয়দ শামসুল হক। বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাকে ‘সব্যসাচী লেখক’ বলা হয়। তার লেখকজীবন প্রায় বাষট্টি বছর ব্যাপী বিস্তৃত। দীর্ঘজীবনে তিনি অনেক উপন্যাস লিখেছেন। তার অনুজ এবং তরুণ লেখকেরা প্রভাবিত হয়েছেন তার লেখায়। তাদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘হক ভাই’ নামে। ছোটগল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কাব্যনাট্য, নাটক, অনুবাদ ইত্যাদি মিলিয়ে ৮০টির বেশি গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। লিখেছেন সিনেমার সংলাপ ও গান। বাঙ্গালি মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি-বিকার সবই খুব সহজ কথা ও ছন্দে উঠে এসেছে তার লেখনীতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অসামান্য অবদান রাখায় তিনি ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ ও ‘একুশে পদক’সহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।

সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও মা হালিমা খাতুন। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। সৈয়দ হক তার বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে সবার বড়।

১৮৭৫ সালের ২২ এপ্রিল কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী এই আটটি থানা নিয়ে কুড়িগ্রাম মহকুমার জন্ম হয়। এরপর ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রাম সদর, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী, রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, ফুলবাড়ী, রৌমারী ও রাজিবপুর এই নয়টি উপজেলা নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলায় উন্নীত হয়। এক সময়ের মঙ্গাপীড়িত এই জেলাটির ‘মঙ্গা কলঙ্ক’ ঘুচে গেলেও দারিদ্র্য এখনও কাটেনি। সরকারি হিসাবেই বর্তমানে ৭০ শতাংশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিয়ে দেশে দারিদ্র্যের শীর্ষে অবস্থান করছে রংপুর বিভাগের আওতাধীন এ জেলা। পাকিস্তান আমলে কুড়িগ্রাম জেলার ৯৮ ভাগ মানুষই ছিল গরিব। স্বাধীনতার পরও প্রায় প্রতি বছরই মঙ্গাপীড়িত হয়ে এক বেলা, আধবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে এই জেলার অসংখ্য মানুষকে। অভাবক্লিষ্ট জেলার সন্তান হয়েও সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন অগ্রগামী। তিনি সাহিত্যের যে শাখাতেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন।
তার শৈশব কেটেছে কুড়িগ্রাম শহরে। শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। সেখানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে। এরপর ১৯৫০ সালে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক ম্যাট্রিক (বর্তমানের এসএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সৈয়দ শামসুল হকের পিতার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন। পিতার ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে তিনি ১৯৫১ সালে মুম্বাই (সাবেক বম্বে) পালিয়ে যান। সেখানে তিনি বছরখানেকের বেশি সময় এক সিনেমা প্রোডাকশন হাউজে সহকারি হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৫২ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী মানবিক শাখায় ভর্তি হন। কলেজ পাসের পর ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীতে স্নাতক পাসের আগেই ১৯৫৬ সালে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর তার প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ (১৯৫৬)’ প্রকাশিত হয়।

সৈয়দ হক তার বাবা মারা যাবার পর অর্থকষ্টে পড়লে চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ‘মাটির পাহাড়’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেন। পরে ‘তোমার আমার’, ‘শীত বিকেল’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বড় ভাল লোক ছিল’, ‘পুরস্কার’সহ অন্তত ১৬টির মতো চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেন। তার ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস অবলম্বনে ২০১১ সালে নির্মিত হয় ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রটি। ‘বড় ভাল লোক ছিল’ ও ‘পুরস্কার’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তার রচিত ‘হায়রে মানুষ, রঙ্গিন ফানুস’ গানটি এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ত্যাগ করে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে বিবিসির বাংলা খবর পাঠক হিসেবে চাকুরি গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসর্মপণের খবরটি পাঠ করেছিলেন। পরে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা বিবিসি বাংলার প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার দৃঢ়কণ্ঠ সাবলীল উচ্চারণের জন্য তিনি জনসাধারণ্যে পরিচিতি লাভ করেন।

সৈয়দ শামসুল হকের ভাষ্য অনুযায়ী, তার রচিত প্রথম পদ তিনি লিখেছিলেন এগারো-বারো বছর বয়সে। টাইফয়েডে শয্যাশায়ী কবি তার বাড়ির রান্নাঘরের পাশে সজনে গাছে একটি লাল টুকটুকে পাখি দেখে দু’লাইনের একটি পদ “আমার ঘরে জানালার পাশে গাছ রহিয়াছে/ তাহার উপরে দুটি লাল পাখি বসিয়া আছে” রচনা করেন। এরপর ১৯৪৯-৫০ সালের দিকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে ব্যক্তিগত খাতায় ২০০টির মতো কবিতা রচনা করেন।

সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের মে মাসে। ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায়। সেখানে ‘উদয়াস্ত’ নামে তার একটি গল্প ছাপা হয়।

সৈয়দ হকের কবিতায় রয়েছে গভীর অনুপ্রেরণা। তার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’ ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়। পরে ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’, ‘পরাণের গহীন ভেতর’, ‘নাভিমূলে ভস্মাধার’, ‘আমার শহর ঢাকা’, ‘বেজান শহরের জন্য কোরাস’, ‘বৃষ্টি ও জলের কবিতা’ কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে পাঠকমহলে জনপ্রিয় করে তুলে। সৈয়দ হক মৃত্যুর আগে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে তার শেষ কবিতা লিখেন। কবিতার নাম ‘আহা, আজ কি আনন্দ অপার!’

তার রচিত ‘এক মহিলার ছবি (১৯৬১)’, ‘অনুপম দিন (১৯৬২)’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪)’ উপন্যাসগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিগত শতকের ষাটের দশকে তার রচিত উপন্যাসগুলো পূর্বাণী পত্রিকায় ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হত। তার রচিত ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসকে অনেকে যৌনআশ্রিত বলে আখ্যা দেন। তিনি উপন্যাসের ভূমিকায় এই উপন্যাসকে ‘এদেশের সবচেয়ে ভুল বোঝা উপন্যাস’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

সৈয়দ হক নাট্যকার হিসেবে সফলতা পেয়েছেন। বিবিসি বাংলায় নাটকে কাজ করার মাধ্যমে তিনি নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি পান। তার ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত একটি কাব্য নাটক। তার পরের নাটক ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’ ফকির বিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত। সৈয়দ হক তার রচনায় সমসাময়িক বাংলাদেশ এবং মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি ও ভালো-মন্দ দিকগুলো তুলে ধরেন। তার অন্যান্য নাটক ‘নারীগণ’, ‘যুদ্ধ এবং যোদ্ধা’, ‘ঈর্ষা’, ‘এখানে এখন’-এ সমকালীন বাস্তবতা ফুটে ওঠেছে। সাপ্তাহিক বিচিত্রার সোনালী যুগে তিনি ‘মার্জিনে মন্তব্য’ নামে একটি নিয়মিত কলাম লিখতেন।

বাংলা সাহিত্যকে তিনি যতটা মেধা আর প্রতিভা দিয়ে ঋদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন, প্রতিদানও পেয়েছেন। সৈয়দ শামসুল হক মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে ১৯৬৬ সালে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ লাভ করেছিলেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেছেন। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘একুশে পদক’ এবং ২০০০ সালে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ লাভ করেন।

বাংলা সাহিত্যের এই হিরণ¥য় পুরুষের প্রাপ্ত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- ‘আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৬৯’, ‘অলক্ত স্বর্ণপদক ১৯৮২’, ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, ১৯৮২, ১৯৮৩’, ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৩’, ‘কবিতালাপ পুরস্কার ১৯৮৩’, ‘লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক’, ‘জেবুন্নেসা-মাহবুবউল্লাহ স্বর্ণপদক ১৯৮৫’, ‘পদাবলী কবিতা পুরস্কার, ১৯৮৭’, ‘নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, ১৯৯০’, ‘টেনাশিনাস পদক, ১৯৯০’, ‘মযহারুল ইসলাম কবিতা পুরস্কার ২০১১’, ‘ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার, ২০১১’ প্রভৃতি।

ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দ হক প্রথিতযশা লেখিকা ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হককে বিয়ে করেন। তাদের এক ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ হক ও এক মেয়ে বিদিতা সৈয়দ হক।

২০১৬ সালের ১৫ এপ্রিল ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিলে তাকে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয়। লন্ডনের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে পরীক্ষায় তার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি দেয়। চার মাস চিকিৎসার পর ২ সেপ্টেম্বর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর (১২ আশ্বিন ১৪২৩ বঙ্গাব্দ) ঢাকার বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর ৯ মাস। পরদিন ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে বেসরকারি টেলিভিশন ‘চ্যানেল আই’ এর তেজগাঁও চত্বরে সকাল ১০টায় প্রথম দফা নামাযে জানাজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে দুপুর ২টায় দ্বিতীয় দফা নামাযে জানাজা এবং অপরাহ্নে কুড়িগ্রামে তৃতীয় দফা জানাজার নামায শেষে তাকে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের পাশে সমাহিত করা হয়। অর্ধযুগ আগে তার কলম থেমে গেলেও সৃষ্টিসম্ভার তাকে বাঁচিয়ে রাখবে যুগ-যুগান্তরে।

তথ্যসূত্র : বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা; বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, রংপুর বিভাগ, কুড়িগ্রাম জেলা, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২।

শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved 2018 shilonbangla.com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com