শনিবার, ২৭ মে ২০২৩, ১২:১৪ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের প্রথম এম.এ. গুরুপ্রসাদ সেন

বাংলাদেশের প্রথম এম.এ. গুরুপ্রসাদ সেন

গুণীজন

বাংলাদেশের প্রথম এম.এ. গুরুপ্রসাদ সেন

১৯০০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর (১৩০৭ বঙ্গাব্দের ২৮ আশ্বিন) ভারতের বাঁকিপুর নিজ গৃহে এই মহানুভব ব্যক্তি পরলোকগমন করেন

সাদ বিন ওয়াহেদ

গুরুপ্রসাদ সেন। পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের প্রথম এম.এ. ডিগ্রিধারী ব্যক্তি। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী, সমাজসেবক, প্রাবন্ধিক ও বিহারের প্রথম ইংরেজি পত্রিকা ‘বিহার হেরাল্ড’-এর প্রতিষ্ঠাতা।

গুরুপ্রসাদ সেনের জন্ম ১৮৪২ সালের ২০ মার্চ (১২৪৯ বঙ্গাব্দের ৮ চৈত্র) ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (অধুনা বাংলাদেশের) ময়মনসিংহ পরগনার ঢাকার ডোমসারে। বর্তমানে ডোমসার হলো শরীয়তপুর সদর উপজেলার পালং মডেল থানাধীন একটি গ্রাম। তার পিতা কাশীচন্দ্র সেন ও মাতা সারদাসুন্দরী দেবী। কাশীচন্দ্র ছিলেন উচ্চ বংশোদ্ভব কুলীন বৈদ্য সন্তান।

গুরুপ্রসাদ সেনের বয়স যখন এক বছর তখন তার পিতা মৃত্যুবরণ করেন। তখন তার মা সারদা দেবী নিরুপায় হয়ে বিক্রমপুরের (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলাধীন) কাঁচাদিয়া গ্রামে তার বড় ভাই রাধানাথ সেনের আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাধানাথ সেন সে সময়ে বিদ্বান ও বুদ্ধিমান বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহ জজ আদালতে ওকালতি করে যথেষ্ট অর্থোপার্জন করতেন। তার নিজের কোন সন্তান ছিল না। গুরুপ্রসাদ সেনকে তিনি নিজের সন্তানের মতন লালন পালন করতেন। গুরুপ্রসাদ সেনকে গ্রামের মক্তবে ভর্তি করা হয়। তখন তিনি গ্রামের মক্তব থেকে বাংলা ও ফারসি শিক্ষা লাভ করেন। সেই সময়ে বিক্রমপুরে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ছিল না।

গুরুপ্রসাদ সেনের ইংরেজি শিক্ষা স্বীয় মামা রাধানাথ সেনের উপার্জনস্থল ময়মনসিংহে আরম্ভ হয়। তিনি ১৮৫৮ সালে ঢাকা পোগোজ স্কুল থেকে বৃত্তিসহ এন্ট্রান্স (প্রবেশিকা) পাশ করেন। বৃত্তি মাসিক কুড়ি টাকা। এরপর তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ঢাকা কলেজ থেকে ১৮৬০ সালে এফ. এ. পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেন। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৬২ সালে বি.এ. এবং ১৮৬৪ সালে এম. এ. পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেন। তিনি পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশে) প্রথম এম.এ. পাশ। তার আগে পূর্ব বাংলার কেউ এম.এ. পাশ করে নাই। তার মেধাশক্তির কথা সর্বত্র প্রচার হওয়ার ফলে বিক্রমপুরের ভিন্ন ভিন্ন গ্রামের লোকজন দলে দলে তাকে দেখতে আসেন।

এম. এ. পাশের পর প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে গুরুপ্রসাদ কর্মজীবন শুরু করলেও ১৯৬৫ সালে বি.এল. পরীক্ষা পাশ করে ডেপুটি ম্যাজিসেট্রট পদে প্রথমে কৃষ্ণনগর ও পরে বাঁকিপুরে কাজ করতে থাকেন। কিন্তু সেখানে ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি “চিরদিন ভিক্ষা করে খাব, তথাপি অন্যের দাসত্ব করব না” এরূপ প্রতিজ্ঞা করে সরকারি পদ ত্যাগ করে বাঁকিপুরেই স্বাধীনভাবে ওকালতি পেশা শুরু করেন। এই বাঁকিপুর তার ত্রিশ বছর কর্মজীবনের মূল কর্মক্ষেত্র হয়েছিল এবং বহু জনহিতকর কাজে লিপ্ত ছিলেন। বিহারের প্রধান প্রধান জমিদারগণের আইনি-উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।

তার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল, নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে নীলচাষীদের পক্ষ অবলম্বন করা এবং তাদের সংগ্রামে সামিল হওয়া। প্রকৃতপক্ষে তার চেষ্টায় বিহারের নীলচাষীরা ইংরেজ নীলকর সাহেবদের অত্যাচার মুক্ত হন। ১৮৭৪ সালে তিনি বিহারে প্রথম ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বিহার হেরাল্ড’ প্রকাশ করেন। এটি বিহার প্রদেশের সর্বপ্রথম সংবাদপত্র। এই পত্রিকার সাহায্যে তিনি জনসাধারণের সপক্ষে সংগ্রাম করে তাদের প্রকৃত বন্ধু হয়ে ওঠেন।

বিক্রমপুরের কাঁচাদিয়া গ্রাম পদ্মায় বিলীন হয়ে গেলে, তিনি কামারখাড়া গ্রামে বসতবাড়ি নির্মাণ করেন। তিনি সে সময় গরীব-দুঃখী মানুষ এবং আত্মীয়-স্বজনদেরকে প্রচুর পরিমাণে সাহায্য সহযোগিতা করেন এবং বিভিন্ন জনহিতকর কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তিনি দরিদ্র ছাত্রদের জন্য হোস্টেল এবং বাঁকিপুরে ও ঢাকায় দুটি স্কুল স্থাপন করেন। মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার স্বর্ণগ্রাম আর. এন. উচ্চ বিদ্যালয়টি ১৮৯৮ সাল থেকে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে চলেছে। গুরুপ্রসাদ সেন তার মামা রাধানাথ এবং মামী স্বর্ণময়ীর নামকে স্মরনীয় করে রাখার জন্য এই বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিদ্যালয়টি একটি মনোরম পরিবেশে অবস্থিত। যা মুন্সীগঞ্জের আর কোথাও নাই।

১৮৭৮ সালে ‘বিহার ল্যান্ড-হোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা তার চেষ্টায় সম্ভব হয়েছিল এবং তিনি এর আজীবন সম্পাদক ছিলেন। ১৮৯৫ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হন এবং পরের বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সেকালের প্রসিদ্ধ পত্রিকা ‘সোম প্রকাশ’ পত্রিকায় তিনি অনেক প্রবন্ধ লিখতেন। গুরুপ্রসাদ সেন বহু দরিদ্র সন্তানকে প্রতিপালন ও বহু শিক্ষার্থীকে নিজ বাসাতে রাখিয়া তাদের শিক্ষার সমুদয় ব্যয়ভার গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি বিহার প্রদেশে থাকিয়া বঙ্গদেশের বিভিন্ন আন্দোলন অনুষ্ঠানে যোগদান করতেন।
জুরির বিচারব্যবস্থা ওঠানোর চেষ্টা হলে তার রচিত ইংরেজি পুস্তিকা বিলেতে (ব্রিটেন) প্রশংসিত হয়েছিল। ইংরেজি ভাষায় তিনি কয়েকখানি পুস্তক রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো – ‘অ্যান ইনেট্রাডাকশন টু দ্য স্টাডি অফ হিন্দুইজম (১৮৯১, প্রবন্ধ সংকলন)’, ‘নোটস্ অন সাম কোয়েশ্চন অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইন ইন্ডিয়া (১৮৯৩)’ প্রভৃতি।

বাঁকিপুরে অবস্থানকালে বিধানচন্দ্র রায়ের পিতা প্রকাশ চন্দ্র রায় ও মাতা অঘোরকামিনী দেবীর সাথে তার পরিচয় ছিল। তাদের মতো তিনিও এক সময় ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। পরে তার ধর্মবিশ্বাসে উদারপন্থী মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল। বিধবাবিবাহের উৎসাহী সমর্থক ছিলেন তিনি। বিপথগামী মেয়েদের বিবাহ ও পুনর্বাসনের পক্ষে নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সূচনা থেকেই তার সমর্থক ছিলেন এবং বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন।

১৮৯৯ সালে তিনি দুই পুত্র সহ ব্রিটেন যান। দেশে ফেরার পথে রোমে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। ১৯০০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর (১৩০৭ বঙ্গাব্দের ২৮ আশ্বিন) ভারতের বাঁকিপুর নিজ গৃহে এই মহানুভব ব্যক্তি পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর।

তথ্যসূত্র : সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খ-, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ১৯১; বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, মুন্সীগঞ্জ জেলা, টঙ্গীবাড়ি উপজেলা, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২; বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, শরীয়তপুর সদর উপজেলা, ১৪ আগস্ট ২০২২।

শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved 2018 shilonbangla.com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com