গুণীজন
এ জনহিতৈষী ব্যক্তিত্ব ১৯৭৭ সালের ১১ নভেম্বর ছাপ্পান্ন বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন
সাদ বিন ওয়াহেদ
এআরএম ইনামুল হক। তিনি হলেন বিশিষ্ট সমাজসেবক, শিক্ষক, কৃতি প্রকৌশলী ও দেশে প্রথম মরণোত্তর চক্ষুদানকারী। মানবিক কর্মকাণ্ডের এক অগ্রণী পুরুষ তিনি।
ইনামুল হক ১৯২১ সালের ১ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া রাজখোলাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে যন্ত্রকৌশলে প্রকৌশল ডিগ্রি অর্জন করেন।
দেশ ভাগের পর বাংলাদেশে চলে আসেন এবং তৎকালীন আহসানুল্লাহ প্রকৌশল কলেজে (বর্তমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট) শিক্ষকতায় যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন।
পরবর্তী জীবনে তিনি বিভিন্ন সংস্থায় সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকালেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। কেবল নিজ পেশা প্রকৌশল বিদ্যাতেই নয়, আরও অনেক বিষয়েও ইনামুল হক ছিলেন বিদগ্ধ পণ্ডিত। তিনি ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন ছিলেন এবং ধানমন্ডি ক্লাব প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে এ ক্লাবটি শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব নামে পরিচিত। বাংলাসহ চারটি ভাষায় তার ছিল সমান পারদর্শিতা। ভাষা ও শিক্ষার ব্যাপারেও তার ছিল সমান আগ্রহ।
বাংলাদেশে প্রথম মরণোত্তর চক্ষুদানকারী এআরএম ইনামুল হকের মৃত্যুর তিন বছর আগে তিনি উইল করে তার চোখ দান করেন। তার একটি কর্নিয়া সংযোজন করা হয় অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ২০০০-এর সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর চোখে ও অপরটি সংযোজন করা হয় রমজান আলী নামে এক ব্যক্তির চোখে।
মৃতের চোখের কর্ণিয়া সংগ্রহ করে অন্যজনের চোখে লাগানোর ইচ্ছা ও সম্মতিই ‘মরণোত্তর চক্ষুদান’ নামে পরিচিত। উল্লেখ্য মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির বৈধ অভিভাবকেরাও কর্ণিয়া দান করতে পারেন। মারা যাবার পর মৃত ব্যক্তির কর্ণিয়া ৬ ঘন্টার মধ্যে সংগ্রহ করতে হবে। কোথাও কোথাও ১২-২৪ ঘন্টার মধ্যে সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা সঠিক নয় বলে আধুনিক গবেষণা বলছে। ছয় ঘন্টার মধ্যে কর্ণিয়া সংগ্রহ না করলে কর্ণিয়া সেলের সংখ্যা কমে যায়। কর্ণিয়া হলো চোখের সামনের স্বচ্ছ অংশ, যার মাধ্যমে আলো চোখের মধ্যে প্রবেশ করে। যদি কোন কারণে কর্ণিয়ায় ঘা হলে বা কর্ণিয়া অস্বচ্ছ হয়ে গেলে ওই চোখে আলো প্রবেশ করতে পারেনা। ঐ চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। এ অবস্থাকে কর্ণিয়াজনিত অন্ধত্ব বলা হয়।
মানুষ মরে গেলে তার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গই কিছুদিনের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। তাই মরেও নিজের চোখ অন্যকে দানের মাধ্যমে চাইলেই বেঁচে থাকা যায় পৃথিবীর আলো-রঙের মাঝে। মৃত্যুর পর অন্যকে কর্ণিয়া দানের রীতিকেই মূলত মরণোত্তর চক্ষুদান বলা হয়। সন্ধানী ন্যাশনাল আই ডোনেশান সোসাইটি’র তথ্য মতে বাংলাদেশে ১৪ লাখ লোক দৃষ্টিহীন। যাদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সন্ধানী বেশ অনেকদিন থেকেই মরণোত্তর চক্ষুদান বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের উদ্যোগেই প্রতিবছর ২ নভেম্বর আমাদের দেশে মরণোত্তর চক্ষুদান দিবসও পালন করা হয়। সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংক বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতিতে ডোনারের মুখের সৌন্দর্যহানি না ঘটিয়ে সম্পূর্ণ চোখ তোলার পরিবর্তে শুধু কর্ণিয়া সংগ্রহ করে থাকে।
কেউ চক্ষুদান বিষয়ে আগ্রহী হলে প্রথমে তাকে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির দেয়া অঙ্গীকারপত্র সংগ্রহ করতে হয়। তারপর তা যথাযথভাবে পূরণ করে সন্ধানী চক্ষু ব্যাংকের ঠিকানায় পাঠাতে হবে। এরপর ডোনারকে চক্ষু ব্যাংক থেকে একটি ডোনার কার্ড সরবরাহ করা হয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বলার প্রয়োজন যে, সংশ্লিস্ট ডোনারকে মৃত্যুর ছয় ঘণ্টার মধ্যে নিকটস্থ সন্ধানী ইউনিট অথবা সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতিতে খবর পাঠাতে হবে।
আমাদের দেশে অনেকেই কেবলমাত্র ধর্মীয় বিধি নিষেধের ভয়ে ইচ্ছে স্বত্ত্বেও চক্ষুদানে আগ্রহী হন না। অথচ পৃথিবীতে প্রচলিত কোন ধর্মেই এ বিষেয়ে কোনো ধরনের বিধি নিষেধ পাওয়া যায়নি। বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থগুলোতে চক্ষুদানের ব্যাপারে কোন ধরনের বিধি নিষেধ পাওয়া যায়নি। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ও চক্ষুদানে কোন বাধা নেই।
এ সম্পর্কে মক্কাভিত্তিক ইসলামি ফিকাহ্ একাডেমি বলেছে, মরণোত্তর অঙ্গব্যবচ্ছেদ বা সংস্থাপন শরিয়তবিরোধী নয়। এছাড়া মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিতরাও চক্ষুদানকে মানবসেবা নামে অভিহিত করেছেন।
তাদের মতে যেহেতু ইসলাম মানবসেবাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে থাকে, তাই মানুষের কল্যাণে মরণোত্তর চক্ষুদান ইসলামবিরোধী হতে পারে না। ওআইসি পর্যন্ত মরণোত্তর চক্ষুদানকে অনুমোদন দিয়েছে।
বাংলাদেশের জীবিত কোন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি (১৮ বছরের বেশি) হতে হবে, তবে ৬৫ বছরের বেশি নয়। তবে জীবিত অবস্থায় কেউ শুধু নিকট আত্মীয়কে কিডনি, লিভারের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করতে পারবেন। কিন্তু চোখ, চর্ম, টিস্যু-ইত্যাদি যে কেউকে দান করা যাবে, সেখানে নিকট আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকা বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু ক্যান্সার, হেপাটাইটিস, এইডস বা কোন জীবাণু সংক্রমণ কোন ব্যাধিতে মারা গেলে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করা যাবে না।
বাংলাদেশ দান করা সবচেয়ে বেশি অঙ্গ-প্রত্যক্ষ হলো চোখ। সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ জয়নুল ইসলাম বলছেন, ১৯৮৪ সালে কার্যক্রম শুরুর পর এ পর্যন্ত তারা প্রায় চার হাজারের মতো কর্নিয়া বা চোখ দান পেয়েছেন। কিন্তু জনসংখ্যা বা বাংলাদেশের মৃত্যুর বিচারে এই সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার কথা। বছরে তারা এখন পাচ্ছেন প্রায় ২৫-২৬ জোড়া চক্ষু। মৃত্যুর পর চোখ প্রতিস্থাপন করতে হয় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে।
সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত তারা ৩৮ হাজারের বেশি মরণোত্তর চক্ষুদানের অঙ্গীকার পেয়েছে। এদের বড় অংশটি তরুণ।
সন্ধানীর মহাসচিব মো. জয়নুল ইসলাম বলছেন, বাংলাদেশে বছরে হাসপাতালগুলোতে ১০ লাখ মানুষ মারা যান। এদের মধ্যে যদি ২০ হাজার কর্নিয়াও পাওয়া যেতো, বাংলাদেশের কর্নিয়ার সঙ্কট মিটে যেতো। বাংলাদেশে বর্তমানে পাঁচ লাখ ২৬ হাজার কর্নিয়ার চাহিদা রয়েছে।
ইনামুল হকের মরণোত্তর চক্ষুদান ছিল তার সমাজসেবা ও সমাজ সংস্কারধর্মী অসংখ্য প্রচেষ্টারই চূড়ান্ত নিদর্শন। এ জনহিতৈষী ব্যক্তিত্ব ১৯৭৭ সালের ১১ নভেম্বর ছাপ্পান্ন বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।
তথ্যসূত্র : সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি ও বিভিন্ন গণমাধ্যম।
Leave a Reply