গুণীজন
কয়েক দশকের বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এ দিকপাল প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০ জুন রাজধানীর মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ইন্তিকাল করেন।
সাদ বিন ওয়াহেদ
এদেশের সাংবাদিকতা, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ; স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন- সর্বক্ষেত্রে অগ্রনী। তার পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও কর্ম জীবন ছিল আলোকিত।
‘কামাল লোহানী’ নামে পরিচিত হলেও, তার পারিবারিক নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন বর্তমান সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার খান সনতলা গ্রামে তার জন্ম। পিতার নাম আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী ও মাতা রোকেয়া খান লোহানী।
কামাল লোহানী প্রথমে কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা শুরু করেন। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে তিনি পাবনা চলে আসেন। ভর্তি হন পাবনা জিলা স্কুলে। ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। সেই কলেজ থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন।
তিনি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকা দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। তার কর্মস্থল ছিল দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তা প্রভৃতি।
কামাল লোহানী সাংবাদিকতা দিয়ে পেশাজীবন শুরু করলেও নানা সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন সবসময়। এদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৫৩ সালে পাবনার তৎকালীন জিন্নাহ্ পার্কে (বর্তমান স্টেডিয়াম) মুসলিম লীগ কাউন্সিলে নুরুল আমিনের আগমনের প্রতিবাদ করায় প্রথম গ্রেপ্তার হন তিনি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করায় আবারও গ্রেপ্তার হন তিনি। ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে পারিবারিক মতবিরোধ হওয়ায় ঢাকা চলে আসেন কামাল লোহানী। ১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর কামাল লোহানী ‘ছায়ানট’র সাধারণ সম্পাদক হন। সাড়ে চার বছর এই দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগ প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে অধুনালুপ্ত ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন কামাল লোহানী।
১৯৯১ সালে তিনি প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ষোলো মাসের মাথায় তৎকালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি পিআইবিতে (প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ) ফিরে আসেন। ২০০৮ সালে দুই বছরের জন্য আবার শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ বেতারের পরিচালক হিসেবে। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ছিলেন চার বছর। ছিলেন গণশিল্পী সংস্থার সভাপতি। তিনি অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। এর বাইরেও তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সদস্য ছিলেন। আরো ছিলেন একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা।
কামাল লোহানী ২০১৫ সালে সাংবাদিকতায় রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। এছাড়াও তিনি কলকাতা পুরসভার দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা, পিআইবি মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সম্মাননা, রাজশাহী লেখক সংঘ সম্মাননা, ক্রান্তি স্মারক, ঋষিজ সম্মাননা ও স্মারক, জাহানারা ইমাম পদক, শুভজন পদক-সহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
কয়েক দশকের বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এ দিকপাল পুরুষ প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০ জুন সকাল ১০টা ১০ মিনিটে রাজধানীর মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ইন্তিকাল করেন। ছিয়াশি বছরের মুখর একটি জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে মহামারির ছোবলে।
তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া; বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী; জাতীয় তথ্য বাতায়ন, সিরাজগঞ্জ জেলা।
Leave a Reply