আজ আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস
শিকদার আবদুস সালাম
আজ ৩২তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ ১ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রবীণ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯১ সাল থেকে দিবসটি সারা বিশে^ যথাযথ মর্যাদার সাথে পালন হয়ে আসছে। প্রবীণদের সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টিই দিবসটি পালনের মূল লক্ষ্য। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ‘বৈশ্মিক মহামারীর বার্তা প্রবীণদের সেবায় নতুন মাত্রা’। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আজ শনিবার ১ অক্টোবর- ২০২২ দিবসটি পালিত হচ্ছে।
মমতাময়ী মায়ের অন্ধকার গর্ভ থেকে মানুষ আলোকিত পৃথিবীতে আসেন আবার অন্ধকার কবরে চলে যান। আসা-যাওয়ার মাঝখানে ‘কিছুক্ষণ’ পৃথিবীর আলো-বাতাসে জীবন গড়েন। লক্ষ-কোটি বছর আগেও পৃথিবীতে মানুষ ছিল এখনও আছেন; যিনি লক্ষ বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে গেছেন সে তুলনায় তার আয়ু সামান্য। এই সামান্য আয়ু নিয়ে আমরাও পৃথিবীতে একসময় ছিলাম শিশু, তারপর কিশোর, যৌবনকাল পেরিয়ে এখন বৃদ্ধ। শিশু পৃথিবীতে আসার সময় আনন্দে ক্রন্দন করে; প্রবীণরা যাওয়ার সময় কিছু না পাওয়ার বেদনায় কাঁদেন। এখান থেকে হাসিমুখে বিদায় হন খুব কম সংখ্যক মানুষ।
শিশুর বাকশক্তি, চোখের দৃষ্টি আস্তে আস্তে আসে। তার মধুমাখা হাসির জন্য সবাই আদর করে কোলে তুলে নেন। তাকে পরিচর্যা করেন। মা তার শিশুটির জন্য সারা রাত জেগে থাকেন, শিশুর পায়খানা প্রস্রাব পরিষ্কার করেন। কেঁদে উঠলে খাবার দেন। প্রবীণদের বেলায় শিশুর সম্পূর্ণ বিপরীতটা আমাদের চোখে পড়ে।
ষাট বছর বয়স হওয়ার আগেই মানুষ বেশ কটি রোগে আক্রান্ত হন (ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শরীর ব্যথা) যা ওষুধ খেলে নিয়ন্ত্রণে থাকে; কিন্তু পুরোপুরি সারে না। আস্তে আস্তে স্মৃতিশক্তি কমে আসে। এক সময় কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেন। তার পরিচর্যার জন্য থাকেন বৃদ্ধ স্ত্রী (যদি জীবিত থাকেন)। আর মহিলাদের বেলায় ছেলের বউ না হয় ঔরসজাত মেয়ে। বৃদ্ধ বয়সে সবচেয়ে কঠিন সমস্যায় পড়েন পুরুষরা।
বলছি প্রবীণ সাংবাদিকদের কথা- সারা জীবন নিজের সামর্থ্যে দাপিয়ে বেড়ানো সাংবাদিকরা জীবন সায়াহ্নে এসে শারীরিক দুর্বলতার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ-সংসারে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। অনেক সময় তাদের দেখার কেউ থাকে না। তাদের সমস্যার ধরণ হতে পারে নানা রকম, যেমন- শারীরিক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক। বেঁচে থাকলে আপনিও একদিন প্রবীণ হবেন। তাই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রবীণদের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা প্রয়োজন। প্রবীণদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে একটি রাষ্ট্র কখনোই কল্যাণ রাষ্ট্র হতে পারে না।
জীবনের শেষ বিকেলে এসে নানা কারণে প্রবীণদের গুরুত্ব কমে যায় পরিবার তথা সমাজ জীবনে। উপার্জন করার সামর্থ্য থাকে না বলে, বিশেষ করে পরিবারে বয়োঃবৃদ্ধ মানুষের গুরুত্ব কমে যায়। এর ফলে শুরু হয় অবহেলা, অযত্ন ও তাচ্ছিল্যতা। ব্যক্তিগতভাবে আয়ের সুযোগ থাকে না বলে অভাব দেখা দেয় তাদের জীবনে এবং তখন তাদের জীবনধারণ করা, নিজের আশ্রয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দুরূহ হয়ে যায়। এজন্য তাদেরকে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়।
একজন সাংবাদিক সারা জীবন সবার জন্য অকাতরে সেবা বিলিয়ে দিয়েছেন, আজ তাকেই যখন জীবন সায়াহ্নে এসে নিজের প্রয়োজনের জন্য পরিবারের অন্য সদস্যদের দিকে হাত বাড়াতে হয়; তখন সে পরিস্থিতি হীনমণ্যতার জন্ম দেয়।
সাংবাদিকতা পেশায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে লড়াই করতে হয়। সংসারে অভাব অনটনের জন্য ৮০ বছর বয়সেও একজন প্রবীণ সাংবাদিককে দেখা যায় দরখাস্ত হাতে কোনো না কোনো গণমাধ্যম অফিসে ধরণা দিতে। সাংবাদিকতা পেশায় যেহেতু অবসর বলতে কোনো শব্দ নেই সেহেতু এখানে কোনো পেনশনও নেই। তাই অন্যান্য পেশার মানুষেরমত চাকরিশেষে পকেটে কিছু টাকা নিয়ে ঘরে ঢুকতে পারেন না। সাংবাদিকরা ঘরে ঢোকেন খালি হাতে। তাদের শেষ জীবনটা যদি পেনশনভোগী কোনো ব্যক্তি দেখেন তবে হতাশ হয়ে যাবেন। রাষ্ট্রের একটি স্তম্ভ সাংবাদিকরা। তাই রাষ্ট্রের নাগরিকদের সেবাদানকারী সেই সাংবাদিকরা যখন প্রবীণ হন তখন তারা অর্থ কষ্টে ধুঁকে ধুঁকে মরেণ।
অনেক সাংবাদিককে সন্তানরা দেখাশুনা করেন। অনেকের সন্তান নাই। তিনি না পারেন আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে, না পারেন নিজের ঘরে থাকতে। দিন কাটে মানবেতর, কারো কাছে বলতেও পারেন না। জাতীয় প্রেসক্লাবে সারাজীবন কাটিয়েও আজ অর্থের অভাবে অনেক সাংবাদিক ক্লাবে আসতে পারছেন না। সারাজীবন লেখনির মাধ্যমে সেবা বিলিয়ে দিয়েছেন আজ তার জন্য সেবা নেই।
জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরি শর্তাবলী) আইন ২০২২’-এ যে কটি ধারা সংযোজন করা হয়েছে তার কোনো ধারায়ই প্রবীণ সাংবাদিকদের বিষয়টি উল্লেখ নেই। চাকরি শুরু ১৮ বছর বয়সে চাকরি শেষ কবে, চাকরিশেষে সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পেনশন/অবসর ভাতা দিচ্ছে। বৃদ্ধ বয়সে আরামে আয়াশে তাদের জীবন কাটছে; কিন্তু সাংবাদিকদের? না তেমন কিছুই নেই, তাই ‘গণমাধ্যমকর্মী আইন-২০২২’ এর ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে ‘প্রবীণ সাংবাদিক’দের সম্মানজনক মাসিক ভাতার বিষয়টি।
বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় ৬০ বা ৬৫ বছর বয়সের পর একজন মানুষকে প্রবীণ বা ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে গণ্য করা হয়। রাষ্ট্র তাদের বিশেষ সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানে সচেষ্ট থাকে। ২০১৩ সাল থেকে আমাদের দেশে প্রবীণ নীতিমালা চালু রয়েছে। সাধারণত ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষকে প্রবীণ বলে গণ্য করা হয়।
কাজেই প্রজন্মকে অনুধাবন করতে হবে, আমরাও একদিন বৃদ্ধ হব। প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে, বয়স বা অসুস্থতার কারণে কাজ করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলা প্রবীণরা তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারেন। জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে প্রবীণরা আমাদের জন্য শুধু সম্পদ নয়, মূল্যবান মানবসম্পদ।
আর সে জন্যই প্রচলিত নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি সমাজে প্রবীণদের জন্য কিছু বিশেষ অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রবীণদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, প্রজ্ঞাবান এ প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে কোনোভাবেই অপ্রয়োজনীয় বা বোঝা হিসেবে গণ্য করা উচিত হবে না।
আমাদের দেশে প্রবীণরা নানা সমস্যার ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকেন। সমাজে মূল্যবোধের বিপর্যয়, নৈতিক শিক্ষার অভাব ও স্বার্থান্বেষী চিন্তা-চেতনার কারণে প্রবীণদের মূল্যায়ন করা হয় না, দেয়া হয় না তাদের প্রাপ্য মর্যাদা। প্রবীণরা তাতে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যান।
বার্ধক্যজনিত কারণে আয়-রোজগার করতে না পারলে রাষ্ট্র থেকে সরাসরি সরকারি সাহায্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সমাজে প্রবীণ ব্যক্তিদের অবদানের স্বীকৃতি দিতে সরকারকে সচেষ্ট থাকতে হবে। পাঠ্যপুস্তক, গণমাধ্যম, সভা, সেমিনার, আলোচনা সভা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রবীণ ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে এবং সঠিক মূল্যায়নের সুযোগ তৈরি করতে হবে।
পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটানো: প্রত্যেক প্রজন্মকে তাদের বাবা-মা এবং প্রবীণ স্বজনদের সেবা প্রদানে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিতকরণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সম্পদ, মর্যাদা, লিঙ্গ, বয়স নির্বিশেষে রাষ্ট্রে প্রবীণ ব্যক্তিদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সমাজে প্রবীণ ব্যক্তিদের শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, নৈতিক ও চিত্তবিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কমানোর জন্য সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি ও প্রবীণদের ক্ষমতায়নে সহায়তা প্রদান করা দরকার।
সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে প্রবীণদের চলাচলের উপযোগী রাস্তা, নিরাপদে ও আরামে বসার মতো আসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রবীণদের কষ্ট কমানোর জন্য পৃথক কাউন্টার স্থাপন করা প্রয়োজন। প্রবীণদের জন্য গ্রাম থেকে শহরে এলাকাভিত্তিক প্রবীণ ক্লাব স্থাপন করা যেতে পারে।
প্রবীণদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রদান করতে পাড়ায় পাড়ায় প্রবীণ হেলথ ক্যাম্প করা যেতে পারে। প্রবীণ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন আছে। সমাজ ও পরিবারে প্রবীণ ব্যক্তিরা যাতে অবহেলা, অবজ্ঞা, বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার না হন- এর প্রতি গুরুত্বারোপ করা দরকার।
রাষ্ট্রের সেবাদানকারী সাংবাদিকরা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। তাদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সুরক্ষা, চিকিৎসা, বেঁচে থাকার জন্য সম্মানজনক ভাতার ব্যবস্থা করা জরুরি। সেবক সাংবাদিক জীবনের শেষপ্রান্তে এসে সুষ্ঠু সুন্দরভাবে বেঁচে থেকে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে চান। আর এই সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থটা রাষ্ট্রই করতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক
Leave a Reply