সুলতানা রিজিয়া : এদেশে যারা প্রবাসী তাদের অনেকেই বাগান বিলাসী। তারা বাড়ির খোলা আঙিনা, বাড়ির চারপাশের জুৎসই জমিনে বা বারান্দার টবে ফল, ফুলের চাষ করেন। মাটির সাথে কোদাল, খুরপি, নিড়ানি, আঁচড়ি বা প্রয়োজনীয় কৃষি হাতিয়ার নিয়ে এরা খেলেন। খেলার মতোই হাসি, খুশি বাগানে ফলনের আবিষ্টতা জড়িয়ে থাকেন। এদের জীবন যাপনের প্রয়োজনে আপন আপন জীবিকার পরিশ্রম, যাতায়াতের ( ড্রাইভ ) নিষ্ঠ মনোযোগ, বাড়ির কাজে হাত লাগানো, সন্তানদের লেখাপড়ার দিকে খেয়াল সবটাই ষোলআনা করতে হয়। না করে উপায় থাকে না। দেশের বাড়ি, গ্রামের মতো হাতের আশেপাশে সাহায্যের সহকারী থাকে না। যার যার কাজ তার তার। তাই তাদের কাজ পড়েও থাকে না। আলস্য শব্দটি এখানে আপেক্ষিক। একান্ত প্রয়োজনে, অনুষ্ঠানে, দীলখুশে এরা রসুইঘরকে ছুটি দেন।
বাইরের খানার প্রতি এদের কম বেশি অনেকের আগ্রহ দেখা যায়। এমনিতে এদেশে ৭০/৮০ ভাগ বাজার সদাই প্যাকেটজাত। কুটা বাছায় ঝঞ্ঝাট নাই বললেই চলে। তাই তাদের ঘরে বাইরের কাজে ছন্দপতন তেমন চেখে পড়ে না।
এতোকিছুর পরও তাদের শখের বাগানের সবজি বাংলাদেশের চেয়ে অনেকাংশে সতেজ ও মনকাড়া। দু’ চোখ মেলে শুধু দেখতেই মন চায়। বিস্ময় জাগে তাদের পরিশ্রমী মনোভাব দেখে।কী অবলীলায় অবসরের মধুময় সময় খরচ করেন ঘাম ঝরিয়ে। মাথার উপর আদিগন্ত তাতানো আকাশ, নীচে বিছানো শীতল মৃত্তিকা।
অক্টোবরে শুরুতেই হিমবায়ুর উৎপাত ও দমকা বৃষ্টির খুনশুটিতে গ্রীষ্মের বারোটা বেজে যায়। নভেম্বর থেকে থেমে থেমে তুষার কুঁচির ঝালর ঝরতে থাকে। আদিগন্ত রোদের বুকে শুভ্র তুষার গলে গলে ঝরে পড়তে থাকে। বৃক্ষ তরু শাখা, তৃণ লতার সবুজ বুক ঢেকে যায় শুভ্র তুষারে। ডিসেম্বরে এদেশের ঘরে ঘরের আগল শক্ত হয়ে আটকে থাকে। বাইরে প্রয়োজন ছাড়া গাড়ির চাকা ঘোরে না। শিশু কিশোর থেকে শুরু করে সকলের কাছে অবারিত প্রকৃতি নিষিদ্ধ হয়ে ওঠে।
আমি আমার বাগান নিয়ে মানসিক অশান্তিতে আছি। প্রতিদিন আবহাওয়া বার্তা জেনে রাখি। লাউয়ের ফলনে প্রফুল্লচিত্তে বাগানে চোখ রাখি। গাছে গাছে টমাটো, ঢ্যাঁরশ, বরবটি ও মরিচ আশা জাগানিয়া আনন্দে দোদ্যুল দোলে। ফুলগাছের আগায়, কোষে কোষে ফুলকলিরা পরিপুষ্ট হয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সূর্যমুখীর কৈশোরী হলুদ আভা চকিত চমকে ফোটার প্রহর গুনছে। চন্দ্রমল্লিকা, অপরাজিতা, কুঞ্জলতা, জিনিয়া, মেরীল্যান্ড ( গাঁদাফুল ) ও নাম না জানা দুই প্রজাতির ফুলের কলিরা পুষ্টতায় সতেজ।
এরা একসাথে ফুটে উঠলেই চৌদিকে আমোদিত হবে তাদের রূপ, রং, সৌরভের আহ্লাদ। আমি অপেক্ষায় থাকি এদের আহ্লাদ দেখার আশায়। শঙ্কিত থাকি একসাথে সকলের হিমমৃত্যু দেখার ভয়ে।
২০১৬ ও ২০১৭ তে দেখেছি কি ভাবে ফলন্ত গাছ একরাতে তুষার স্পর্শেই নির্জীব হয়ে যায়। কোন বিকল্প আশা কিম্বা শোক করার অবকাশ পাইনি!
এদেশে আপন হাতের সবজি বা ফুল বন্ধু বান্ধবদের উপহার হিসেবে দেওয়ার রেওয়াজ আছে। হোক দুইটা বা পাঁচটা। কী আনন্দ এই দেয়া নেয়ায়, বলে বোঝানো যাবে না।
গত রবিবারে মেয়ের বান্ধবীর বাড়িতে বাগানের সবজি রান্না ও খাওয়ার আয়োজনে গিয়েছিলাম। অসাধারণ! এদেশে খড়ি বা কাঠের চুলায় রান্নার দৃশ্য অভাবনীয়! ছোটবেলার বনভোজনের মতো।
মাটি খুঁড়ে চুলা, চারপাশে আনাজপাতি, কোটা বাছা, হৈ চৈ ধোঁয়ায় মাখামাখি রান্নার এলাকা। গ্রাম্য পরিবেশ তৈরী করার চেষ্টায় আয়োজনের চারপাশে ছিলো বাঁশের খুঁটির মাথায় কেরোসিনের প্রদীপ! বড়ই উপভোগ্য ও বৈচিত্র্যময় সেই আয়োজন। এরা আড্ডার সাথে গানবাজনাকে যোগ করে। প্রায় পঞ্চাশ জনের এই আয়োজনে বাগানের সবজির রকমারী আইটেমের সাথে ছিলো আরো অনেক খাবার। মেয়েদের ছিলো বাদ্যের তালে তালে বলিশ ছোড়া খেলা। গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর নিপুণ ও পরিপাটি পরিচর্যায় বাড়ির ফুলের বাগান ছিলো মনকাড়া।
বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা এদেশের বুকে কী সুন্দর ভাবে নিজেদের মেধা, দক্ষতা, কর্মকৌশল ও পরিশ্রমে আপন জায়গা করে নিয়েছে, ভাবতেও ভালো লাগে। অথচ আমার দেশের মানুষ আইন শৃঙ্খলার অবনতিতে, পরিবেশ পরিস্থিতির নৈরাজ্যে, জীবন যাপনের ঘোড়দৌড়ে সদা শঙ্কিত, বিমর্ষ। আমরা আমাদের যাপিত জীবনকে শান্তিময়, স্বস্তিময়, নির্বিঘ্ন করার উদ্দেশ্যেই মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করেছিলাম। যুদ্ধজয়ে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছিলাম। আজ প্রায় পঞ্চাশ বছরেও আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পেরেছি কি?
আমরা অনেকেই এর উত্তর খুঁজে পাই না! উত্তর সুদূরপরাহত।
০৭/০৯/২০১৯
Leave a Reply