শনিবার, ২৭ মে ২০২৩, ১১:০৫ পূর্বাহ্ন

চৌচালা ঘরের সুখ | সালমা বিনতে শামছ

চৌচালা ঘরের সুখ | সালমা বিনতে শামছ

চৌচালা ঘরের সুখ | সালমা বিনতে শামছ

টিনের গায়ে হলুদ রং করা, লম্বাটে চৌচালা ঘর, বৃত্তাকার বৃহৎ উঠোন, প্রবেশ মুখের ডান দিকে আরেকটি চৌচালা ; অপেক্ষাকৃত ছোট।
দু’টো চৌচালা ঘিরে উঠোন থেকে একটু আড়ালে দেয়াল বিহীন খুটি আর ছাদ ওয়ালা রসুই ঘর- রসুই ঘরের পাশে বৃদ্ধ নারিকেল গাছ, বয়সের ভারে শরীরের সৌন্দর্য্য ম্লান হয়েছে সেই কবে ; অথচ ফলন সারা বছর। মিষ্টি পানীয় আর ধবধবে দুধ নারিকেল।
উঠোনের ডান পাশে ছোট্ট পুকুর। দু’য়ের মাঝখানে আম গাছ, যার অর্ধেক আম স্পর্শ করে জল, আর অর্ধের স্পর্শ করে স্থল।

কোন এক রবিবার রাতের শেষ ভাগ অর্থাৎ সোমবারের প্রারম্ভ, বড় চৌচালা ঘরটায় জন্ম নেই। সেদিন আনন্দে পুরো বাড়ি মুখরিত হয়ে যায়। বাড়িতে এই প্রথম দ্বিতীয় প্রজন্মের জন্ম – প্রাণের আগমন।
নানু,মামা,নানা আর ছোট আন্টু (খালা কে আন্টু ডাকতাম) আদরে ভালোবাসায় শিখিয়েছেন পৃথিবী।

একটু একটু করে হেঁটে বেড়াতাম পুরো বৃত্তাকার উঠোন জুড়ে। মামা আদর করে দু ঘরের মাঝখানে টিনের বেড়ায় গোট গোট অক্ষরে রং করে লিখে রেখেছেন
“S A L M A”।

শিক্ষক নানা ভাই ছুটিতে বাড়িতে এলেই সারাক্ষণের সঙ্গি করে রাখতেন।
বাবা ও শিক্ষক ; ছুটিতে এসে প্রথম সন্তানের মায়ায় বিদায়ের সময় আড়ালে চোখের জল লুকাতেন।

মাকে ভিষণ জ্বালাতাম। কান্নায়, না খাওয়া।
দু’টো মামা আর ওই আন্টুর স্পর্শ ভালোবাসায় একটু একটু করে জুতার সাইজ যখন তিন থেকে সাতে এসে পৌঁছালো। ততক্ষণে হলদে টিনের চৌচালাটা বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি।

কোন এক দিন সেই টিনের ছায়ার অবস্থান ছেড়ে বহু ক্রোশ দুরে পিতা মাতা ভাই বোন সমেত নতুন পৃথিবীতে থাকতে শুরু করলাম।
কিন্তু মনটা পড়ে থাকতো সেই পুকুর ঘাঁটে, হলদে টিনের ঘরটাতে, নানুর লোহার পানের বাটার ঝনঝনানিতে।

সারা বছর চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা ; সবাই মিলে যাবো সেই মাটি স্পর্শ করতে।
আসবো শুনে অপেক্ষমাণ নানুর সেই দৃষ্টি কত প্রহর ফুরিয়ে যায়।
দুর থেকে দৌড়ে গিয়ে নানুর বুকে ঝাপিয়ে পড়া।

ছোট চৌচালাটার পিছনে লম্বা খাল, কালো বর্ণের জল। সে জলে কৈ শিং এর বাহার।
ছিপ-বড়শির কৌশলে দু’বেলা ভাতের সাথে মাছের বন্দোবস্ত সহজেই হয়ে যেত।
মাছ ধরার নেশা নানুর ধারাবাহিকতায় মা তার পরে ভাই – ভালো ভাবেই রপ্ত করে নেয়।

পুকুরে স্নানের সময় এক ডুবে মুহুর্তেই হাতের মুঠোয় মাছ বন্দি-আমার কাছে অভাবনীয় লাগত।

আমি বড়জোর ছিপ-বড়শিতে দু’চার টা পুঁটির দেখা পেতাম। হয়তো ধৈর্য নেই বিধায়।

কতই না সুন্দর সেই ক্ষন গুলো ; দিনগুলো
হাসিমাখা মুখ গুলো।

দিনের বিবর্তন ; চৌচালাকে পিছন করে বৃত্তাকার বৃহৎ উঠোনে ইট-কংক্রিটের দালান।
সেই লম্বাটে কালো জলের খালে মাটি ভরাটে প্রসস্থ রাস্তা।
নেই, কিছুই নেই। আদর মাখা নানার মুখটি গত হয়েছে। সেই থেকে কালো চাদরে ঢেকে গেছে আমার সেই জন্মস্থান মায়ের বাড়ি।
নানার পরলোক গমন, বড় মামার অপ্রত্যাশিত ইহজগৎ বিয়োগ। আন্টুর বিয়ে নামক নব্য কারাগারে বন্দি। সর্বশেষ দেহ খাঁচায় বাস করা রোগের আলিঙ্গনে বটবৃক্ষ নানুর চির বিদায়।

এখন মাটির মেঝেতে টাইলস বাঁধা- তাতেই বাঁধা পড়ে গেছে সকল সুখ। হারিয়ে গেছে হাসি। আনন্দ তো সমাধিস্থ। কি আজব পৃথিবী- কি আজব আমাদের জীবন। এখন আর মন টানে না, কারন এখন আর অপেক্ষমাণ কোন দৃষ্টি নেই পথ পানে। অজান্তে… ঘুমের ঘোরে, কিংবা জাগরণে চোখের পাতায় ভাসে চিরবিদায়ী চেনা মুখ গুলো। বৃত্তাকার উঠান, চৌচালা ঘরের সুখ। অামি পারি না ভুলতে হয়তো পারবো ও না। [এই প্রথম এলো মেলো কিছু বাক্য লিখতে গিয়ে চোখের নোনা জলকে দামিয়ে রাখতে পারলাম না, হাতের কম্পন খুব করে অনুভব করছি]

পনেরো, মার্চ || দু হাজার বিশ

শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved 2018 shilonbangla.com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com