বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:২৯ অপরাহ্ন

কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা : কর্মক্ষেত্রে ফাঁকি ও স্বজনপ্রীতি নিষিদ্ধ

কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা : কর্মক্ষেত্রে ফাঁকি ও স্বজনপ্রীতি নিষিদ্ধ

কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা

কর্মক্ষেত্রে ফাঁকি ও স্বজনপ্রীতি নিষিদ্ধ

মিকাইল হোসেন

গত ৫ই সেপ্টেম্বর রাজশাহীর বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ সরকার নির্ধারিত সঠিক সময়ে অফিসে আসেন কি না এ বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে কতৃপক্ষ সাংবাদিকদের ব্যাপক মারধর করেন। কারণ সঠিক সময়ে কেউ অফিসে ছিলেন না। এটি দেশের অধিকাংশ অফিসের চিত্র।

কোন ধর্মেই হোক বা বিধানেই হোক কর্মে ফাঁকি দেয়া সমর্থন করে না। এটি একটি অন্যতম দুর্নীতির উপায়। কর্মে ফাঁকি দেওয়া অর্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। সুতরাং এটিও একধরনের জুলুম ও দুর্নীতি। কোন অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে জনগণের থেকে অবৈধ সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে স্বীয় কর্তব্য পালন না করে বা কর্মে ফাঁকি দেয়ার মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। তোমাদের প্রত্যেককেই স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। বুখারী, হাদীস নং-৪৭৮৯

তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা জালিমদের অবকাশ দিয়ে রেখেছেন, শেষ পর্যন্ত যখন তাকে ধরবেন তখন তাকে আর অবকাশ দিবেন না। এবিষয়ে তিনি আরো বলেন, অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়াকে ভয় কর। কেননা ঐ দোয়া এবং আল্লাহর মধ্যে কোন পর্দা থাকে না। বুখারী,হাদীস নং-যথাক্রমে ৪৩১৮ও ৪০০০

আল্লাহর রাসূল সা. একদিকে বলেছেন, ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও। (ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-২৪৩০)

অন্যদিকে শ্রমিককে তার সঙ্গে চুক্তিকৃত কাজে ফাঁকি না দিয়ে পূর্ণ সামর্থ্য অনুযায়ী করার নির্দেশ দিয়েছেন।

বর্তমান বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদ আর ভোগবাদী অর্থনীতিতে যে কোনো মূল্যে মানুষ নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে শটকার্ট উপায়ে সফল হতে চায়। বাংলাদেশে বিশেষ করে চাকুরিজীবীরা কর্মক্ষেত্রে ফাঁকি দেয়াকে দুর্নীতি মনে করে না। অতিরিক্ত লাভ ও লোভের নেশায় তারা ফাঁকি দেয়। কর্তব্য জ্ঞান ভুলে তারা অনৈতিক পথে নিজ অফিস রেখে অন্য অফিসে কাজ করে। তারা ভুলে যায় প্রতিদিন আট বা দশ ঘণ্টা নিজ কর্মক্ষেত্রে কাজ করার জন্য কর্তৃপক্ষ তাদেরকে বেতন দেয়। নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত সেবা দেওয়া তার দায়িত্ব। সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের অফিসের কাজে ফাঁকি দেয়ার উৎসব হয়। তিনি নির্ধারিত সময়ে অফিসে না থাকার কারণে সেবা প্রার্থীকে যথাসময়ে যথাযথ সেবা প্রদানে ব্যর্থ হন। সেবা প্রার্থীকে তার কাছে বারবার যেতে হয় মূল্যবান অর্থ ও সময় নষ্ট করে ফলে তার ভোগান্তি বহুগুণে বেড়ে যায়। বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে কাজে ফাকি দেয়ার প্রবণতা মারাত্মক বেড়েছে। বর্তমানে সরকারি অফিসের সময়সূচী সকাল আটটা থেকে বিকাল তিনটা। সকাল আটটায় কতজন অফিসে আসেন? কতজন সকাল আটটা থেকে তিনটা পর্যন্ত অফিসে থাকেন? কতজন দুপুরে যথাসময়ে নামাজ ও খাওয়া শেষ করে নিজের টেবিলে সেবা দেয়ার জন্য বসেন? অসংখ্য চিকিৎসক সরকারি হাসপাতালে নির্ধারিত সময় কর্মস্থলে না থেকে বেসরকারি হাসপাতালে অতিরিক্ত অর্থের লোভে সেবা দেন। সরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেসরকারি বিশ্ব বিদ্যালয়ে ক্লাস নেন অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে। ফলে নিজ বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হন। বিদেশে গিয়ে সঠিক সময়ে দেশে না ফিরলেও অনেকে বেতন ভাতা উত্তোলন করেন নিয়মিত। সম্প্রতি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে কর্মকর্তাদের সঠিক সময়ে অফিসে থাকার ব্যাপারে একজন ছাত্রের অনশন সবার দৃ®িট আকর্ষণ করেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের অসংখ্য শিক্ষক অফিসের নির্ধারিত সময়ে অফিসে না থেকে ব্যক্তিগতভাবে প্রাইভেট পড়ান বা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেন যা শতভাগ অনৈতিক। অনেকেই সুযোগ পেলেই অফিসচলাকালীন সময় বাসায় চলে যান। সরকারি কলেজের শিক্ষকবৃন্দ সরকার নির্ধারিত অফিস সময়ে অধিকাংশ শিক্ষকই থাকেন না।

কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কেউ যদি নির্ধারিত সময় অফিসে না থেকে বাইরে চলে যান এবং যে কোনোভাবে লাভবান হন তার বেতন তাহলে হালাল হবে না। আর বেতন হালাল না হলে কোনো ইবাদাতই কবুল হবে না। আর ইবাদাত কবুল না হলে জাহান্নাম অবধারিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাই প্রশ্ন ওঠে সকাল আটটার অফিস কয়টায় শুরু হয়? শুধু আর্থিক দুর্নীতি -দুর্নীতি নয়। কর্মক্ষেত্রে কাজে ফাঁকি দেওয়া বড় ধরনের দুর্নীতি। অন্যকে বা অন্যের সন্তানকে ফাঁকি দিলে নিজেকে বা নিজের সন্তানকেও অন্য কেউ ফাঁকি দিবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। বর্তমানে অফিসে থেকেও কাজ না করে ফাঁকি দেওয়ার অন্যতম উপকরণ হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহার। অনেক শিক্ষক ক্লাসে বসে না পড়িয়ে ফেসবুক ব্যবহার করেন- যা কোনো মতে গ্রহণযোগ্য নয়।

স্বজনপ্রীতি দুর্নীতির আরেকটি উপায়। সাধারণত ব্যক্তিগত রাগ, ক্ষোভ ও লোভের বশে যোগ্য লোককে দায়িত্্¦ না দিয়ে অযোগ্য লোককে সুবিধা দেয়াকে স্বজনপ্রীতি বলে। এক্ষেত্রে অনেক সময় আত্মীয়, দলীয় বা নিজের পক্ষের লোকজন এ অনৈতিক সুবিধা পায়। ফলে যোগ্য লোক যোগ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। দায়িত্বপ্রাপÍ হওয়া অর্থ হচ্ছে আমানাতদার হওয়া আর যে আমানতের খেয়ানাত করে সে মুনাফিক। আর মুনাফিক জাহান্নামের সর্বনি¤œ স্তরে থাকবে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা তার পবিত্র কুরআনে বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন আমানাত তার মালিককে প্রত্যার্পণ কর। ৪ : ৫৮

মহানবী সা. এ বিষয়ে বলেন, যে ব্যক্তি মুসলমানেেদর কোন বিষয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় তারপর যে আনুকূল্যের ভিত্তিতে গভর্নর বা কোনো কাজে কাউকে নিয়োগ করে তার উপর আল্লাহ তায়ালার অভিশাপ। তাকে দোযখে প্রবেশ করানোর পূর্বে আল্লাহ তার কোনো ফরজ বা নফল ইবাদাত কবুল করবেন না। (হাকেম, সনদ সহীহ ও হাসান আইউব ইসলামের সামাজিক আচরণ, পৃ : ১১৪)

তাই মনে রাখতে হবে, কাজে ফাঁকি দেয়া ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে দুর্নীতি করলে তাকে কঠোরভাবে জবাবদিহী করতেই হবে। কর্মস্থলে কাজে ফাঁকি দিলে বা স্বজনপ্রীতি করলে বেতন হালাল হবে না।

লেখক : উপাধ্যক্ষ (শিক্ষা), পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কলেজ সাভার , ঢাকা

শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved 2018 shilonbangla.com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com