শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৪:০২ পূর্বাহ্ন

কিংবদন্তি আলেম ও রাজনীতিবিদ শামছুল হুদা পাঁচবাগী

কিংবদন্তি আলেম ও রাজনীতিবিদ শামছুল হুদা পাঁচবাগী

গুণীজন

কিংবদন্তি আলেম ও রাজনীতিবিদ শামছুল হুদা পাঁচবাগী

এই প্রখ্যাত মনীষা, বাংলার প্রথম সারির স্বাধীনতাকামী রাজবন্দী ১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ শহরের ব্রাহ্মপল্লীতে নিজ বাসভবনে ইন্তিকাল করেন।

সাদ বিন ওয়াহেদ

পিতা-মাতার রাখা নাম মো. শামছুল হুদা। শামছুল হুদা অর্থ ‘হেদায়েতের সুর্য’। কালক্রমে মেধা, মনীষা আর সাধনা বলে হয়ে উঠেন মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী। দেশের একজন কিংবদন্তি আলেমে দ্বীন ছিলেন। তিনি একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কামেল পীর ও রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব। ধর্ম, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সকল জনগনের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তিনি বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য ছিলেন।

মাওলানা শামছুল হুদা পাচঁবাগী ১৮৯৭ সালে (১৩০৩ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাস) তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার দক্ষিন মহকুমার অধীন গফরগাঁও থানার অর্ন্তগত মাইজবাড়ী নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কিছুদিন পরে তার পিতা গফরগাঁওয়ের পাঁচবাগ নামক গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে সেই পাঁচবাগ গ্রামটি এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের বাসস্থান হওয়ার জন্য বিখ্যাত হয়ে যায়। তিনিও এই গ্রামেই লালিত-পালিত হয়ে বিশ্বের দরবারে মাওলানা পাচঁবাগী নামেই খ্যাতিলাভ করেছেন। জন্মসুত্রে তিনি এমন পিতার সন্তান ছিলেন যিনি শিক্ষা, সাধনায়, জ্ঞানে ও অধ্যাত্মিকতায় যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধন করে ছিলেন। তার নাম মৌলভী ক্বারী মো. রিয়াজ উদ্দিন। তিনি ভারতের প্রখ্যাত আলেম রশিদ আহম্মদ গঙ্গুহী (র:) এর খলিফা ছিলেন। অন্যদিকে তার মাতা উম্মে কুলসুমও ছিলেন একজন অত্যন্ত আল্লাহভীরু, পরহেজগার নারী।

শিশুকালে তিনি মাতার কাছে শিশু শিক্ষা শুরু করেন। কোন স্কুল বা মাদরাসায় ভর্তি না হয়ে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। তিনি এতই মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন, যে কোন বিষয়ই একবারের অধিক পরার প্রয়োজন হত না। তবে এই অসাধারন স্মৃতিশক্তি ও তীক্ষ্ম মেধাকে ‘আল্লাহ পাকের খাস দান’ বলে তিনি নিজেই বর্ণনা করতেন। এরপর, তিনি ভারতের রামপুর স্টেট মাদরাসায় ভর্তি হয়েছিলেন।

মাদরাসায় ভর্তির পর হতেই শামছুল হুদার প্রতিভার বিকাশ ঘটতে থাকে। তিনি খুব আগ্রহের সাথে প্রতিটি শ্রেণিতে সিলেবাস বর্হিভুত নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। প্রথম বিভাগে প্রথম হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করে ছিলেন। তিনি জামাত-ই-উলার চুড়ান্ত পরিক্ষায় অংশগ্রহন করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৯৮% নম্বর প্রাপ্ত হয়ে মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার ও স্বর্নপদক লাভ করেন। অতপর উচ্চ শিক্ষার ব্যাপারে তিনি শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ ক্রমে দ্বীনি ইলমের পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষা লাভের জন্য ভারতের রামপুর স্টেট মাদরাসায় ভর্তি হয়ে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে সেখানে গমন করেন। সেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্নপদকপ্রাপ্ত ছাত্রকে দেখার জন্য শিক্ষিত মহলে সাড়া পড়ে যায় এবং রামপুর স্টেটের নবাব বাহাদুরও তাকে ডেকে নিয়ে সাক্ষাৎ করে তার প্রতি সম্মান জানান।

মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার পুর্বেই হাদিসের ক্লাসে স্বেচ্ছায় যোগদান করেছিলেন তিনি। মুহাদ্দিস একটি হাদিস পড়ানোর পর মাওলানা শামছুল হুদা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মুহাদ্দিসকে বললেন, এই প্রসঙ্গে হযরত আলী (রা.) থেকে বর্নিত আরেকটি হাদিস রয়েছে যা উল্লেখ করলে বিষয়টি অধিকতর বোধগম্য ও পরিস্কার হতে পারে। অত:পর তিনি সেই হাদিসখানা মুহাদ্দিসের অনুমতিক্রমে বিশুদ্ধভাবে বর্ননা করলেন। মুহাদ্দিস বিস্মিত হয়ে বললেন, যে ছাত্র হাদিসের এমন উচ্চ পর্যায়ের কিতাব পড়াশোনা করেছে তার আর এখানে ভর্তি হয়ে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। বরং নিজের দেশে গিয়ে জনগনের সেবা করাই উত্তম।

তখন রামপুর মাদরাসার অধ্যক্ষ ছিলেন মাওলানা আব্দুল আজিজ সাহারানপুরী। তিনি ছিলেন দর্শনশাস্ত্রের উঁচু স্তরের পন্ডিত। মাওলানা শামসুল হুদা তার কাছ থেকে দর্শনের পাঠ গ্রহণ না করে দেশে ফিরতে চাচ্ছিলেন না। তবে মাওলানা সাহারানপুরীও ছিলেন কিঞ্চিৎ কঠোর স্বভাবের। ফলে তিনি মনে মনে কিছুটা ভীতও ছিলেন। এরপরেও সাহস সঞ্চার করে মাওলানা সাহারানপুরীর কাছে দর্শনপাঠের আবেদন জানান। সেখানেও তিনি সফল হন। একের পর এক দর্শনশাস্ত্রের বড় বড় সব কিতাব আত্মস্থ করে ফেলেন। মাওলানা সাহারানপুরী তার উপর আশ্বস্ত হলেন এবং বললেন, তোমার পড়ালেখা সম্পন্ন বলেই আমি আশা করি। তুমি এখন দেশে ফিরে জনসেবায় নিয়োজিত হওয়াই বেশী মঙ্গলজনক হক।
মাওলানা শামসুল হকের জ্ঞান অন্বেষণের নেশা তখনো কাটেনি। তিনি ইংরেজি শিক্ষার জন্য লাহোরের ওরিয়েন্টাল কলেজে চলে যান। ওরিয়েন্টাল কলেজ থেকে মাওলানা শামসুল হকের তেমন কিছু শেখার ছিল না। তিনি তখনো ভাল মানের ইংরেজি জানতেন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর দেশ থেকে বাবার টেলিগ্রাম পান এবং দেশে ফিরে আসেন।
পড়ালেখা শেষ করে নিজ দেশে ফিরে আসার পর মাওলানা পাঁচবাগী কৃষকদের জন্য কাজ শুরু করেন এবং ব্রিটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামেন। তিনি জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেন। তার আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে জমিদারদের বাজার বর্জন করেছিল সাধারণ মানুষ। তিনি মুসলমানদের অন্যতম পবিত্র ঈদুল আযহায় গরু কুরবানির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার বিরোধী ছিলেন। ঈদের নামায আদায়ের পর তিনি হোসেনপুরে কুরবানির ঈদ উপলক্ষে গরু কুরবানি করেছিলেন।
শামছুল হুদা পাঁচবাগী ১৯৩৭ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত আইনপ্রণেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ১৯৩৭ সালে শেরোবাংলা একে ফজলুল হকের ‘কৃষক প্রজা পার্টি’র প্রার্থী হিসেবে গফরগাঁও-ভালুকা নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রথম বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। শেরে বাংলার সেই বিখ্যাত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ‘বাংলার মানুষের জন্য ডালভাতের’ দাবিটি মাওলানা পাঁচবাগীর পীড়াপীড়িতেই গৃহীত হয়েছিল। তিনি কৃষকদের বিরুদ্ধে অন্যায় ও জুলুমের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ করার ব্যাপারে তৎকালীন যে কোনো রাজনীতিকের চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ়চেতা ছিলেন।

এরপর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বিরোধিতা করে তিনি ১৯৪৫ সালে ‘ইমারত পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যার সভাপতি ছিলেন তিনি নিজে এবং মহাসচিব ছিলেন ড. সানাউল্লাহ বার এট ল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাবিত ‘সিরাজুদ্দৌলার বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা’ কামনা করে অন্য একটি প্রচারপত্রে মাওলানা পাঁচবাগী লেখেন :
“আমরা নিখিল বাংলার সন্তান
সিরাজুদ্দৌলার বাংলা নামে অভিহিত
কলিকাতাময় নিখিল বাংলা
অবশ্যই চাই।
মোদের এহেন দাবি করিতে হবে পূরণ
মন্ত্রের সাধন হোক, আর শরীর পতন।
কে রোধিতে পারে প্রাক্তনের গতি
মোদের আন্দোলন চলিবে নিতি।
তাই বলি
ওগো পান্থ কেন ক্ষান্ত হও হেরি দীর্ঘ পথ
উদ্যম বিহনে পুরো কিবা কার মনোরথ।
বিনীত―
কলিকাতাময় সিরাজুদ্দৌলার নিখিল বাংলার সন্তান
(মওলানা) মোঃ শামছুল হুদা (পাঁচবাগী)
বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতাকামী রাজবন্দী
প্রেসিডেন্ট, ইমারত পার্টি―বিভাগ-পূর্ব তথা শ্যামা-হক- সোরাবর্দ্দী প্রস্তাবিত কলিকাতাময় বিরাট বাংলাদেশ।” এসব প্রচারপত্র ছিল মাওলানা পাঁচবাগীর রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার।
মাওলানা পাঁচবাগী শুধু ইশতিহার প্রকাশ করে ক্ষ্যান্ত হননি, প্রতিরোধও করেছেন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে গফরগাঁও নির্বাচনী এলাকায় মুসলীম লীগের প্রার্থী ছিলেন গিয়াসউদ্দিন পাঠান। তাকে জেতানোর জন্য মুসলীম লীগ সর্বশক্তি নিয়োগ করে। মুসলীম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা লিয়াকত আলী খান, বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিম উদ্দিন, মাওলানা সাব্বিরসহ বহু নেতা নির্বাচনী প্রচারের জন্য ট্রেনযোগে গফরগাঁও এলে লাখ লাখ জনতার প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। গোটা বাংলায় মুসলীম লীগ জয়লাভ করলেও গফরগাঁওয়ে পাঁচবাগী এবং বরিশালে শেরে বাংলা বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য হিসেবে জয়ী হন। ওই সময় তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইশতিহার লিখেন। এ ইশতিহারগুলো তার নিজস্ব প্রেস থেকে ছাপা হতো।
তিনি পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধী ছিলেন। তিনি অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার সমর্থক ছিলেন। তিনি পাঁচবাগে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, আরবি, উর্দু ও ফার্সি ভাষায় ১০ হাজারের বেশি প্রচারপত্র ছাপিয়েছিলেন। তিনি প্রচারপত্রে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সরাসরি বিরোধিতার জন্য ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করে এবং তার প্রেস বাজেয়াপ্ত করে। দীর্ঘদিন তাকে অন্তরীণ করে রাখা হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় মাওলানা পাঁচবাগী পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ‘মোদের কপালে ছাই/রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শীর্ষক শিরোনামে হাজার হাজার প্রচারপত্র বিলি করে ময়মনসিংহের জনসাধারণকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সোচ্চার করে তোলেন। ১৯৫৪ সালে মাওলানা পাঁচবাগী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে গফরগাঁও-ভালুকা আসন থেকে পূর্ববঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা বিরোধী একটি ইশতিহারে তিনি লেখেন :
“মিছে কেন পাকিস্তান জিন্দাবাদ
ইংরেজ তাড়াই, পাঞ্জাবি আনতে চাই
বাংলা নহে স্বাধীন, বাংলা চির পরাধীন
পাকিস্তান নয়, ফাঁকিস্তান
পাকিস্তান হবে জালেমের স্থান।”

কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসংখ্য ইশতিহার ও প্রচারপত্র বের করেন মাওলানা পাঁচবাগী। কয়েকটি প্রচারপত্রের নমুনা দেয়া যাক :
১. “পাকিস্তান ইজ ফাঁকিস্তান অব বাকিস্তান/ পাকিস্তান ইজ নাথিং বাট ফলস বোগাস।”
২. “জিন্নাহ ব্রিটিশের দালাল/ কে বলে মোদের দুলাল।”
৩. “পাকিস্তানের মোহে পড়ি/ আজ আমাদের গলায় দড়ি/ দিল্লীর লাডডু পাকিস্তান/ পেয়ে না পেয়ে সব সমান।”

আইয়ুব শাসনের ঘোর বিরোধী ছিলেন মাওলানা পাঁচবাগী। ঢাকার নওয়াব হাবীবুল্লাহ ছোট্ট গ্রাম পাঁচবাগকে ‘ছোট্ট জাপান’ বলে আখ্যায়িত করায় মাওলানা পাঁচবাগী তার উত্তরে এক প্রচারপত্রে আইয়ুব খাঁর শাসনের কথা উল্লেখ করে লেখেন :
“পাঁচবাগ ছোট্ট জাপান, মিথ্যে কথা নয়
ঢাকার নওয়াব হাবীবুল্লাহ সত্যি কথা কয়।
পাঁচবাগ ছোট্ট জাপান
একদিন ঘটাবে আইয়ুব শাসনের অবসান।”

এসব প্রচারপত্র প্রচারের দায়ে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। ব্রিটিশ সরকার, জমিদার সংগঠন এবং পাকিস্তান সরকার তার বিরুদ্ধে ১০১৭টি মামলা দায়ের করে। এসব মামলার কারণে তাকে ময়মনসিংহ শহরে আট বছর নজরবন্দি হিসেবে আটকে রাখা হয়। ‘অচিরেই দুই বাংলা এক হইতে পারে―বাংলাদেশের জনগণ হিন্দু-মুসলমান উভয়ই এ আশা করতে পারেন’ শীর্ষক এক প্রচারপত্রে তিনি লেখেন : ‘আমার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বহু মোকদ্দমা আনীত হয়, যার ফলে জেল, জরিমানা এবং বিকল্প সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ হইয়া এক দীর্ঘকাল আমাকে কারাবরণ ও নির্বাসন ভোগ করিতে হয়।’

বিগত শতকের ষাটের দশকে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন না। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে আশ্রয় দেয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের সহযোগিতা করেন তিনি। রাজাকার, আলবদর ও পাকিস্তানি হায়েনাদের হাত থেকে হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সব মেয়েদের রক্ষা করার চেষ্টা করতেন। তিনি নিজে বিভিন্ন গ্রামে, মহল্লায় বাসিন্দাদের খোঁজ নিতেন এবং নিরীহ ও বিপদে পড়া মেয়েদের নিজের জিম্মায় নিয়ে আসতেন। তাদের আশ্রয় দিতেন তার বাড়িতে। কাউকে কাউকে তিনি মসজিদ, মাদরাসা ও স্কুলে আশ্রয় দিতেন। সকল আশ্রিতের খাবারের ব্যবস্থা করতেন এবং মুক্তিযুদ্ধে আগ্রহী যুবকদেরকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য নির্দেশ দিতেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে তিনি ছিলেন আস্থাভাজন ব্যক্তি, তিনি ছিলেন একজন কামেল সুফি, সাধক ও প্রতিবাদী নেতা। যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।

শামছুল হুদা পাঁচবাগী শাহজাদী বেগম ওয়াক্ফ স্টেটের মোতোওয়াল্লি ছিলেন। তিনি ‘দ্বীন দুনিয়া’, ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ ও ‘তর্জুমানে দ্বীন’ শিরোনামের তিনটি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। তিনি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এই প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, বাংলার প্রথম সারির স্বাধীনতাকামী রাজবন্দী, দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচিত এমএলএ ও এমএনএ মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী ১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ শহরের ব্রাহ্মপল্লীতে নিজ বাসভবনে ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। স্থান সংকুলানের অভাবে পরপর আটটি নামাযে জানাযা শেষে পাঁচবাগ জামে মসজিদের কাছে তার পিতা-মাতার কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

তথ্যসূত্র : শাহ শরীফ, ‘মুক্তিযুদ্ধে মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী’, যুগান্তর, ঢাকা, ৪ ডিসেম্বর ২০২০; ‘মুক্তিযুদ্ধে মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষাই ছিল তার ব্রত, রাইজিংবিডি.কম-ঢাকাভিত্তিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭; ‘আলেমদের জীবন ও কর্মের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই!’, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ঢাকা, ২৮ জুন ২০১৯; ‘বাংলাদেশের জন্ম ও মাওলানা পাঁচবাগীর ভূমিকা’, দৈনিক ভোরের কাগজ, ঢাকা, ২০ ডিসেম্বর ২০১৪; বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, ময়মনসিংহ জেলা, গফরগাঁও উপজেলা, ২৫ জানুয়ারি ২০২০।

শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved 2018 shilonbangla.com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com