আ ব দু ল্লা হ আ শ রা ফ
মাওলানা শামসুল ইসলাম সাহেব রহ. আমাদের বাবা হুজুর। প্রাণের হুজুর। কাছে দূরের সব মানুষের আপন হুজুর। এমন মনের মানুষ আর হয় না। সহজে কাউকে আপন করে নেয়ার মতো মানুষ আজকাল খুব একটা পাওয়া যায় না। এমন কাউকে হয়তো পাওয়া যাবে না; হুজুরকে ডেকেছেন আর হুজুর তার ডাকে সাড়া দেননি।
খুব সহজ আর সাবলীল ভাষায় প্রতিটি ক্লাস করাতেন। বার্ধক্য যেন তাকে ছোঁয়ে যায়নি। মুতা‘আলায় বিমুগ্ধ দেখেছি সবসময়। দরসি কিতাবেই সীমাবন্ধ ছিলেন না, তার পড়াশোনাও দৌড় ছিল অনেক। প্রায় দেখেছি লাইব্রেরিতে দাঁড়িয়ে কিতাব পছন্দ করতে। তার মুতাআলার রুমে গেলে মনে হবে, এ এক অন্য জগত। নিজেই একজন জ্ঞানের জগত ছিলেন।
একলা চলছেন। কেউ কাছে আসলে হাতটা ধরে সরল পথে হেঁটে যেতেন। হাল-হাকিকত জিজ্ঞেস করে ছেড়ে দিতেন। পথে কখনো সাক্ষাৎ হয়ে গেলে হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করতেন, ‘কী করিস?’ উত্তর দেয়ার পর মাশাআল্লাহ বলতেন। কখনো জোর করে পান খায়িয়ে দিতাম। খুব খুশি হতেন।
ছাত্র শিক্ষকদের মাঝে একটা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকে। এ সম্পর্কটা আজকাল খুব একটা দেখা যায় না। হুজুর সে সম্পর্কটা জিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। হুজুরের সামনে দিয়ে পালিয়ে যাওয়াটা ছিল অসম্ভব। দেখলেই ডাক দিয়ে কানে মলে দিতে ভুলতেন না।
কোনো উস্তাদকে কোনো কাজে ডাকা বা পরামর্শ নিতে ভয় পেলেও; মাওলানা শামসুল ইসলাম সাহেব হুজুরের সঙ্গে পরামর্শ করতে ভয় হতো না। তিনি মন উজার করে পরামর্শ দিতেন। সাহস যোগাতেন।
হুজুরের বাসায় অনেক বার যাওয়া হয়েছে। হুজুর অপ্যায়ন করেছেন মন উজার করে। প্রতিবারই কৃতজ্ঞতায় ভরপুর ছিল তাঁর হৃদয়। মানুষের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মতো এমন উদার মানুষ কমই দেখেছি। ঠোঁট দুটি কেমন সুন্দর আকৃতি ধারণ করে বলতেন, ‘এই আবদুল্লাহডা আসছিস?’
আমাদের ক্লাসে দু’জন আবদুল্লাহ ছিলাম। দু’জনকে ডাকতে গিয়ে প্যাঁচ লেগে যেতো। তাই তিনি আমার নাম দেন, আবদুল্লাহ আল মুকাম্মাল। আহ! কী সুন্দর করে ডাকতেন। শত ব্যস্ততার মাঝে আপন করে কাছে ডাকতে ভুলতেন না।
একদিন এক রিকসা ঠিক করলাম, লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে মাদরাসায় চলে আসবো। এ সময় হুজুর উপস্থিত। হাতে বাজার। রিকশা খোঁচ্ছেন মনে হলো। আমি গনিমত মনে করে হুজুরকে রিকশা উঠিয়ে দিলে হুজুর বললেন, ‘এই! তোই উঠ।’ হুজুরের সঙ্গে বসে বাসায় গিয়ে বাজারটা দ্বিতলায় দিয়ে আসলাম। এতো আদর-ভালোবাসা ও স্নেহ মিশিয়ে এমন করে আর কে ডাকবে?
বার্ধক্যে উপনীত হয়েও যে মানুষটা চির সবুজ ছিলেন, তিনি মাওলানা শামসুল ইসলাম সাহেব হুজুর। আমাদের বাবা হুজুর। এ বার্ধক্য অবস্থায়ও হুজুরের ভেতরে জিহাদের যে জজবা ছিল, অতুলনীয়। আমাদের রক্ত অনেক সময় বসে যায়। হুজুর খুঁচিয়ে ধমকীয়ে আমাদের জাগিয়ে দিতেন। দেখলে মনে হয় তিনি অনেক নরম। কিন্তু রাজপথে শাহ সাহেব হুজুরের সঙ্গে সবসময় থেকে লড়াই করেছেন। যখন যেখানে যাওয়ার প্রয়োজন পরেছে, নিজ উদ্যমে ছুটে গেছেন।
শাহ সাহেব হুজুর বাবা হুজুরকে মোফসসীরে মিল্লাত উপাধী দিয়েছিলেন। শহীদি মসজিদে তিনি দীর্ঘ দিন কুরআন তাফসীর করেছেন। হাজার হাজার নারী-পুরুষ শহীদি মসজিদে ছুটে আসতো হুজুরের তাফসীর শুনতে। তাঁর স্বপ্ন ছিলো পুরো কুরআন তাফসীর করে শেষ করবেন। আমপারার মাঝামাঝিতে উপনীত হওয়ার সময়ে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সময়টা খুব ভালো না। এ খারাপ সময়ে তিনি মহিলাদের ভেতর এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন। কিশোরগঞ্জবাসী কখনো তা ভুলবে না। আজ ঘরে ঘরে কান্নার রুল পড়ে গেছে। আকাশে-বাতাসে আজ শোকের মাতম। যা বলে কখনো প্রকাশ করা যাবে না।
লেখক : কবি ও গল্পকার
৮ ফেব্রুয়ারি -২০২১
Leave a Reply