সগির আহমদ চৌধুরী : গাড়ি থেকে নেমে হাত-মুখ ধুয়ে বসেছিলাম খানা বাসমতি রেস্টুরেন্টের নিচতলায়। আমরা তিনজন, চারজনের গ্রুপ টেবিলে একাই বসেছিলেন এক ভদ্রলোক। তিনি কথা বলছিলেন চট্টগ্রামের ভাষায়, ভাব-সাব গ্রাম্য মাতব্বরের ন্যায়। মাথায় টুপি আছে, তবে লেবাসে-পোশাকে চরমোনাইঅলাদের কেউ হবেন তা মনে হলো না। সুন্নতি পোশাক দূরে থাক, দাঁড়িটুকুও ঠিক মতো ছিল না তাঁর। আমরা তিনজন তাঁর টেবিলে গিয়েই বসলাম।
বললাম, চট্টগ্রাম্মুত্তুন আইস্যন্দে পল্লাই (চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন মনে হয়!)। জি। চট্টগ্রাম কোথায় আপনার বাড়ি? রাঙুনিয়া। আল্লামা শাহ আহমদ শফী (দা. বা.)-এর দেশ? জি; আমাদের একই গ্রাম, তিনি আমাদের আত্মীয় হন এবং আমাদের মুরব্বিও। সমাবেশে এসেছেন? জি, আমরা আরও অনেকে এসেছি। অনেক কথার মাঝে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কোন দায়িত্বে আছেন আন্দোলনের?
তিনি বললেন, আমি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি! বিষ্ময়সহকারে জিজ্ঞাসা করলাম, তা হলে এখানে? অতঃপর তিনি যা বললেন তা সোনালি হরফে লিখে রাখার মতো, তিনি বললেন, ‘আমরা তো মুসলমান, মৃত্যু তো একদিন হবে। আল্লাহর কাছে কি জবাব দেব? এতো দিন আওয়ামী লীগ করেছি দেশে একটি শক্তিশালী ইসলামি দল ছিল না বলে। এখন পেয়েছি আল-হামদু লিল্লাহ, জীবনের বাকি সময়টা চরমোনাইয়ের পীর সাহেব হুযুরের নেতৃত্বে দীন প্রতিষ্ঠায় কাটিয়ে দেবো ইন শা আল্লাহ। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো একটি বৃহত্তর ও শক্তিশালী দলের বিদ্যমান থাকতে এতে শরীক না হলে কাল কিয়ামতে আল্লাহ তাআলার কাছে কী জবাব দেবো?’
১৯৯৭-৯৮ সালের সময়গুলোতে ঢাকায় ইসলামী আন্দোলনের যেকোনো সমাবেশে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রাম থেকে সাকুল্যে দুইতিনেক গাড়ি যোগদান করতো। সেজন্যে নেতৃবৃন্দকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন দীনী মাদরাসা ছাত্র-শিক্ষার্থীদের দিকে চেয়ে থাকতে হতো, বিনেপয়সায় যানবাহনের ব্যবস্থাপনা করতে হতো স্থানীয় শাখাকে। এখন তো মাদরাসাসমূহে বেশ কড়াকড়ি, ৫ অক্টোবরের মহাসমাবেশে কোনো ছাত্র-শিক্ষার্থীই তেমন অংশ নিতে পারেনি। তা সত্ত্বেও শুধু চট্টগ্রাম মহানগরের মোট ১৬টি সাংগঠনিক থানা শাখা থেকে সর্বমোট ১২০টি ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনের বড় বড় বাসের বিশাল বহর মহাসমাবেশে যোগদান করেছে। সমাবেশব্রতী জনগণ এতে নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করেই তাঁরা শামিল হয় এবং সমাবেশের খরচ মেটানোর জন্যে সাধ্যানুযায়ী দানও করে যায়।
ইসলামপন্থি দলসমূহের প্রতি মাদরাসানির্ভরতার সাধারণ এক শেকায়েত রয়েছে। এ-ধরনের অনুযোগ যে অনেকাংশে সত্য ইসলামি নেতৃবৃন্দের বয়ান থেকেও সেটা সুসাব্যস্ত। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশের অব্যবহিত পর জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সিনিয়র যুগ্নমহাসচিব অ্যাডভোকেট মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরী এক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এতে তিনি বলেছেন, ‘আরজাবাদ, বারিধারা, ইসলামবাগ, মানিকনগর ও সুবহানিয়ার ছাত্ররা আসলেই দশ হাজারের কাছাকাছি হয়ে যাবে। বাকি তো রইল শতাধিক মাদরাসা।’
এখানে তিনি দলীয় অকৃতার্থতার মধ্যে সান্ত¡নাস্বরূপ যে-অভিব্যক্তি পেশ করেছেন তাতেই বোঝা যায় ইসলামি দলসমূহ কতটা জনবিচ্ছিন্ন, বলয়-শ্রেণি বা গোষ্ঠীনির্ভর। ইসলামী আন্দোলনের সফলতা এখানেই যে, মাদরাসানির্ভরতা কাটিয়ে গণমুখী, জনসম্পৃক্ত ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে যথেষ্ট কৃতার্থ হয়েছে দলটি। ৫ অক্টোবর রাজধানী ঢাকার সোহরাওয়ারদী উদ্যানে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশ ইসলামী আন্দোলনের বিপুল জনপ্রিয়তা, তাদের শক্তি-মত্তা ও মজবুত গণভিত্তির পরিমাপ-পরিমাণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।
অন্তর্কোন্দল, বিবাদ-বিরোধ ও বিতর্কে তিক্ত-বিরক্ত হয়ে অনেকটা অভিমান করে সাধারণ মানুষ ইসলামপন্থিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ইসলামপন্থিদের মাঝে এই ছিন্নভিন্নতা যুগের পর যুগ দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসার ফলে জনসাধারণ অত্যন্ত আশাহত; তারা ইসলামি শক্তির উত্থান, ইসলামি বিপ্লব ও ওলামানেতৃত্বের ব্যাপারে হাতাশা, নিস্পৃহা ও নিরুৎসাহে ভুগছে। জনগণ তৃতীয় কোনো অপশনই খুঁজে পায়নি যা প্রকৃতার্থেই আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মতো কায়েমি-দায়েমি শক্তিকে যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে পারে এবং জনগণের ঘাটে জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে থাকা এসব অপশক্তির দুঃশাসন, অপশাসন এবং স্বৈরাচারিতা থেকে নাজাত দেবে।
দেশে অনেকগুলো ইসলামি দলের অস্তিত্ব রয়েছে; কেউ পড়ে আছে শত বছরের ঐতিহ্য নিয়ে, কেউ কেউ সময় কাটাচ্ছে অতীত গৌরবগাঁথা গেয়ে, কেউবা নির্দিষ্ট বলয়বৃত্তি চর্চা করছে। যারা নির্দিষ্ট দলীয় গ-ির বাইরে বেরুতেই চায় না এবং আজীবন মৃত্যুশয্যায় শায়িত দলীয় নাম, ঐতিহ্য ও অতীত খ্যাতি বহন করেই চলে। এর বাইরে নিস্পৃহ জনমানসে প্রাণসঞ্চারী দৃশ্যমান কোনো কর্মতৎপরতা তারা জাতিকে উপহার দিতে পারিনি। যদি ইসলামপন্থিরা একটি শক্তিশালী প্লাটফরম এবং আশাজাগানিয়া তৎপরতা দেখাতে পারলেই সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনীতি ছেড়ে পঙ্গপালের ন্যায় ছুটে আসতো ইসলামের দিকে।
বতিক্রমী ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এক্ষেত্রে তারা অসাধারণ সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। আশাহত ইসলামপ্রিয় জনগণের মাঝে আশার সঞ্চার করেছে, ইসলামপছন্দ নিস্পৃহ জনসাধারণের মাঝে ইসলামের জাগরণের স্পৃহা জাগিয়েছে, ইসলামি শক্তির উত্থানে অনীহ হয়ে ইসলামপন্থিদের সাথে অনেকটা অভিমান করে যারা আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের মাঝে ইসলামের দিকে ফিরে আসার তাগাদা অনুভব করাতে সক্ষম হয়েছে ইসলামী আন্দোলন।
চট্টগ্রামের রাঙুনিয়া থানার আওয়ামী লীগের জনৈক ওয়ার্ড সভাপতির মতো লাখ লাখ মানুষ আজকে তাদের প্রত্যাশিত ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে ইসলামী আন্দোলনের মাঝে, তারা অঙ্গীকারাবদ্ধ যে, জীবনের শেষসময়টি পর্যন্ত তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাবে। এখানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দাবি করার মতো কৃতিত্ব অর্জন করেছে এবং আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে মোকাবেলা করার মতো সক্ষমতা লাভ করতে চলেছে তারা।
৫ অক্টোবরের মহাসমাবেশে ব্যাপক লোকসমাগম প্রমাণ করে যে, মজবুত সাংগঠনিক ভিত্তি এবং আশাজাগানিয়া তৎপরতা দেখাতে পারলে জনগণ ইসলামপন্থিদের পাশেই এসে দাঁড়াবে। কৌতুহলের ব্যাপার হচ্ছে, ইসলামী আন্দোলনের এই সাফল্য ও কৃতিত্বগাঁথার পেছনে রহস্য কী? এর পেছনে কয়েকটি করণ সক্রিয়। উদাহরণসহ আমি এখানে সেসব উপস্থাপন করছি। যথা-
এক.
ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও সুফি-দরবেশদের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালবাসা বিদ্যমান। মূলত পরিবেশগত দিক থেকে ভারতভূমি ছিল ঋষি-মুনি, সাধু-সন্ত ও সন্ন্যাসব্রতীদের জন্য আধ্যাত্মিক সাধনার অত্যন্ত উপযোগী একটি জনপদ এবং এ-অঞ্চলের মানুষরাও ঐতিহ্যগতভাবে আধ্যাত্মিক সাধক পুরুষদের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিল।
যখন ভারতে মুসলমানদের আগমন ঘটে কিংবা এখানকার অধিবাসীরা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয় তাঁরাও সেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করতে থাকে এবং একই ধারাবাহিকতায় মুসলমানরা আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও সুফি-দরবেশদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালবাসা বজায় রাখে। তবে দুঃখজনকভাবে মুসলমানি সুফি সাধনায় শিরক-বিদআত ও অনৈসলামিকতার প্রার্দুভাব ঘটে, ফলে সুফি সাধনা বিষয়ে ইসলামি চিন্তাবিদদের মধ্যেও মতবিরোধ দেখা দেয়।
আহলে হাদীস চিন্তাবিদগণ সুফি সাধনাকে সম্পূর্ণই শিরকি কাণ্ড আখ্যা দিয়ে এর মূলোৎপাটনে চরম পর্যায়ের কঠোরতা অবলম্বন করেন। অন্যদিকে ওলামায়ে দেওবন্দ সুফি-দরবেশদের প্রতি মুসলমানের ভক্তি-ভালবাসার যে-সম্পর্ক তাকে একটি ‘শক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় সেই শক্তিকে কাজে লাগাতে প্রয়াসী হন। তাঁরা সুফি সাধনার তরীকাকে মূলোৎপাটনের পরিবর্তে সংশোধনের পথপরিক্রমা ও কর্মকৌশল গ্রহণ করেন।
বস্তুত সুফি-দরবেশদের প্রতি মানুষের ভক্তি-ভালবাসার যে-সম্পর্ক তা অত্যন্ত শক্তিশালী, অটুট-অচূর্ণ, সুদৃঢ় ও স্থায়ী এক শক্তি সেটি। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সেই শক্তিকে যথাযথ কাজে লাগিয়েছে আর এটিই দলের সাফল্যের পেছনে বিস্ময়কর ফল দিয়েছে। বাংলাদেশে হাজার হাজার দরগাহ, মাযার ও দরবার রয়েছে। মানুষ সেখানে কথিত পীর-দরবেশকে সম্মানপ্রদর্শনে সাজদা করে, তাদের পদতলে অর্থ-সম্পদ অকৃপণচিত্তে বিলিয়ে দেয়। সাধারণ মানুষ তো বটে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিত মানুষও এর ঊর্ধ্বে ওঠতে পারেনি। এটাকে মূর্খতা, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও অন্ধত্ব বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
মূলত এটি একটি শক্তি যা মানুষকে সত্যি দুর্বল করে, যা থেকে শিক্ষিত মানুষও ঊর্ধ্বে ওঠতে পারেনি। চরমোনাইয়ের পীর সাহেবগণ মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে পুজি করে অটেল ধন-সম্পদের মালিক হয়ে যেতে পারতেন, মানুষের ভক্তি-ভালবাসার সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যিক দরবার গড়ে তুলতে পারতেন, সেখানে তাঁরা স্বর্ণ-সিংহাসনে আরাম করতে পারতেন এবং সোনার পালঙ্কে ঘুমোতেও পারতেন। কিন্তু তাঁরা সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন একটি দীনী আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে।
চট্টগ্রাম শহরের গলি-ঘুঁজিয়ে কিছু মাহিন্দ্রা, অটোরিক্সা ও জিএনজি দেখতে পাওয়া যায়, ‘পীর সাহেব চরমোনাই’ নামে। ওসবের গায়ে মরহুম পীর সাহেবের বিভিন্ন বাণী-প্রবচন লিখিত রয়েছে। যেমন, ‘নেতা নয়, নীতি চাই’, ‘আল্লাহই সকল ক্ষমতার উৎস’, ‘ক্ষমতার মোহই সকল সন্ত্রাসের জন্মদাতা’, ‘নামায কায়েম করুন’, ‘আপনার শিশুকে মকতবে পাঠান’ ও ‘৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ হাজার মকতব প্রতিষ্ঠা করুন’ ইত্যাদি। আমার জানা মতে, এসব যানবাহনের সঙ্গে দলীয় পরিকল্পনার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি পীর সাহেব চরমোনাইয়ের প্রতি তাঁর কোনো ভক্ত-অনুরক্তের ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছুই নয় আমার কাছে।
এ থেকেই পরিমাপ করা যায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সাধারণ মানুষের মননজগতে কতটা গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। আমরা কি অধ্যাপক গোলাম আযম কিংবা মতিউর রহমান নিজামী মরহুমদের ক্ষেত্রে এই একই কথা কল্পনা করতে পারি? তাঁদের নামে সাধারণ যানবাহনের নামকরণ হবে! মানুষ কি তাঁদেরকে সেভাবে নিয়েছে? তাঁরা রাজনীতিবিদ, এর বাইরে সাধারণ জনগণের মধ্যে তাঁদের দ্বিতীয় কোনো প্রভাবপরিচয় গড়ে ওঠেছে কি?
৫ অক্টোবর চর্তুদিক থেকে বিশাল বিশাল মিছিলের ঢেউ আঁছড়ে পড়ছিল সোহরাওয়ারদী উদ্যানে। মিছিলগুলোতে কৃষক-শ্রমিক, বালক-বৃদ্ধ, শিক্ষিত-সাধারণ, ধনী-গরিব সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলন ঘটেছিল। আমার অনুসন্ধানী চোখ বারবার ব্যতিক্রমী কিছু দেখতে এবং নতুন কিছু খুঁজে পেতেই বেশি তৎপরত ছিল। দেখতে পাই যে, নিঃস্ব-পথের ফকিররাও নুরানি এ-মিছিলে শামিল রয়েছে। আছে পঙ্গু-প্রতিবন্ধী অনেক লোকও। হুইল চেয়ারে চড়ে এসেছে কেউ কেউ, দু’পায়ের রানের গোড়া থেকে কাটা এক তেজোগর্ভ মানুষকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়েছি, যিনি সামনে দিকে ধেয়ে আসা এক মিছিলকে পেছনে রেখেই তাঁর দু’হাতের ওপর ভর দিয়ে অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে চলছিলেন।
মনে হচ্ছিল যেন তিনিই মিছিলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেলেন। সুফি-দরবেশদের প্রতি মানুষের ভক্তি-ভালবাসার যে সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের শক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোয় ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত এতোটা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছুছে বলে আমার বিশ্বাস।
আর এখানেই ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতের মধ্যকার সাফল্য-ব্যর্থতার পার্থক্য নির্ণিত হয়। নিঃসন্দেহে জামায়াত একটি শক্তিশালী সংগঠন। তবে দলটি মোটেও গণমুখী নয়, কঠোরভাবে ক্যাডারভিত্তিক একটি সংগঠন এটি। ফলে জামায়াতের সংগঠনের পরিব্যপ্তি একটা শিক্ষিতমহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য উপযুক্ত জনশক্তি এবং শিক্ষিতশ্রেণির অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে শিক্ষিত-মূর্খ, ধনী-গরীব এবং সুস্থ-প্রতিবন্ধী সবাই সমান মর্যাদার অধিকারী।
ইসলামি রাজনীতিতে এ ধরনের সার্বজনীনতা লাভের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে সুফি তরীকা। যেটি জামায়াত সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এবং অপরাপর ইসলামি দলসমূহ এটিকে অস্বীকার না করলেও এর চর্চা, অনুশীলন ও কাজে লাগানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি বা এক্ষেত্রে তাদের মাঝে দারুন ঘাটতি রয়েছে।
দুই.
ইসলামী আন্দোলনের সাফল্যের দ্বিতীয় বড় উপদান হচ্ছে আদর্শিক দৃঢ়তা। ইসলামি রাজনীতি মূলত আদর্শিক রাজনীতির নাম। প্রচলিত রাজনীতির দুঃশাসন, পশ্চিমা রাজনীতিক মতাদর্শের ব্যর্থতা এবং দলীয়ভাবে সংখ্যাগরিষ্টের জুলম-শোষণের অবসান করে সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ইসলামি রাজনীতির উদ্দেশ্য।
ইসলামপন্থিদেরকে এই আদর্শবাদিতায় সুদৃঢ় থাকতে হবে। আজকে যারা দুর্নীতি করছে, জনগণের ওপর জুলম-নিপীড়ন চালাচ্ছে, সম্পদ লুটপাট করছে, অপচয়-অপব্যয় করছে ইসলামপন্থিদের সংগ্রাম তো তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেটা না করে যদি ইসলামপন্থিরা এদের কারো বন্দনা করেন এবং তাদের সহযোগীতে পরিণত হন তাহলে জনগণ উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পায় না। জনগণ কথিত সংগ্রামীদেরকে জালিমের সঙ্গে একই পাল্লাতে মাপে এবং তাদের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে। কাজেই জনগণের আস্থা অর্জন করতে হলে আদর্শিক দৃঢ়তা অত্যন্ত জরুরি। এটি শুধু ইসলামি রাজনীতি বলে নয়, যেকোনো উদ্দেশ্যপ্রসারী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
উদাহরণত পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক ইমরান খানের কথাই ধরা যাক। ১৯৮৮ সালে জেনারেল জিয়াউল হক ইমরান খানকে মন্ত্রিত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ইমরান খান তাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ১৯৯৩ সালে তত্ত্বাবধায়ক কোরেশি সরকারের পক্ষ থেকে আবারও তাকে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তব দেওয়া হয়, কিন্তু তিনি তাও প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯৯৬ সালে তিনি তার রাজনীতিক দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন। নওয়াজ শরীফ তাকে ১৯৯৭ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের ২০টি আসনের একটি জোট প্রস্তাব করেছিলেন, তিনি তাও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ১৯৯৭ সালে প্রথম নির্বাচনী লড়াইয়ে অংশ নিয়ে সব আসনে অত্যন্ত খারাপভাবে হেরে যান। ২০০২ সালের নির্বাচনের আগে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ মুসিলম লীগ (কায়েদে আজম)-এর সঙ্গে যোগদানের জন্য তাকে বাধ্য করার চেষ্টা করে সফল হননি। সেই নির্বাচনে ইমরানের দল মাত্র একটি আসন পায়।
পক্ষান্তরে পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের কায়েদ মাওলানা ফজলুর রহমান ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতো বেনজির ভুট্টোর মন্ত্রীসভার পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সভাপতি মনোনীত হন। এরপর ২০১৮ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রায় প্রত্যেকটি সরকারেরই ক্ষমতার অংশীদার ছিলেন তিনি। মাওলানা ফজলুর রহমান ব্যক্তিগতভাবে হয়তো সৎ ছিলেন, কিন্তু বারংবার বিভিন্ন স্বৈরশাহী, দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের সঙ্গে সঙ্গ দেওয়ার দরুণ তিনিও জনগণের আস্থা হারিয়েছেন।
২০০২ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে ৬ দলীয় জোট মজলিসে মুত্তাহিদা আমল গঠিত হয়, নির্বাচনে এ জোট জাতীয় পরিষদে ৬৪টি আসল লাভ করে, যা সেই সময় তাঁদের প্রত্যাশার চেয়ে অতিরিক্ত ছিল। কিন্তু শরীকদের আপত্তি উপেক্ষা করে মাওলানা ফজলুর রহমান সেনাশাসক পারভেজ মুশাররফের সরকারের পালিত বিরোধী দলীয় নেতার ভূমিকা গ্রহণ করেন, যার ফলে জোটটি ভেঙে যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পূর্বে সাবেক ৫টি শরীক দলের সমন্বয়ে জোটটি পুনরুজ্জীবিত হয়। কিন্তু কাক্সিক্ষত ফলাফল তো দূরের কথা, শরীক দলগুলো ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিচ্ছিন্নভাবে যে পরিমাণ আসন অধিকার করেছিল তাও এবার ধরে রাখতে পারেনি। ওই নির্বাচনে তারা যেখানে পঞ্চাশের কাছাকাছি আসন পেয়েছিল এবার তা জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়েও তেরতে এসে টেকেছে।
অথচ ১৯৯৬ সালে রাজনীতিক দল গঠনের পর ২০০২ সালে প্রথমবারের মতো একটি মাত্র আসনে জয় পেয়েছিলেন ইমরান খান। ২০১৩ সালের নির্বাচন পর্যন্ত ইমরান খান ওই একটি আসনেই জিতে এসেছেন। ২০১৩ সালের নির্বাচনে বেশ কিছু আসনে জয় পান এবং ৪ বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালের শতাধিক আসনে জিতে ক্ষমতায় অধিষ্টিত হতে সক্ষমতা লাভ করেন। এটি সম্ভব হয়েছে ইমরান খানের আদর্শিক দৃঢ়তার কারণে। তিনি রাজনীতিক দল গঠন করার পর থেকে দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় অপচয় ও অপব্যয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি আপোষহীন অবস্থান গ্রহণ করেন। প্রলোভন, এমপি-মন্ত্রিত্বের নানা অফার ও অর্থ-সম্পদের লোভ কিছুতেই তিনি বশীভূত হননি।
পাকিস্তানের জনগণও মুসলিম লীগ-পিপলস পার্টির পর্যায়ক্রমিক শাসন-শোষণের কবল থেকে মুক্তি চাচ্ছিল, কিন্তু এতো দিন তাদের সামনে তৃতীয় কোনো অপশন ছিল না। অল্পদেরিতে হলেও ইমরান খানের এই আপোষহীনতা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এবং তা তাকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দেয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মোকাবেলায় ইসলামপন্থিরাও তৃতীয় অপশন হয়ে ওঠতে পারতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও ইসলামপন্থিরা শোষক-দুর্নীতিবাজ ও জালিমশাহীর ক্ষমতায় আরোহণের বাহনে পরিণত হয়েছে। লোভ-লিপ্সার ক্ষেত্রে একজন ইমরান খানের যে পরিমাণ আত্মত্যাগ, রাজনীতিক আপোষহীনতা ও আদর্শিক দৃঢ়তা রয়েছে তার কিঞ্চিৎও বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদের মধ্যে নেই। এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। নেতৃত্বের আদর্শিক দৃঢ়তা, রাজনীতিক আপোষহীনতা এবং নানা প্রলোভনের সামনে মাথা না নোয়ানো ইসলামী আন্দোলনের সাফল্যে বিশাল ভূমিকা রেখেছে।
অবশ্য একথাও বাস্তব যে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ক্ষমতা অধিকারের মতো সক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারেনি। তাঁদের এই অসামর্থ্য ও অপারংগমতার অবস্থা আরও অনেক টার্ম বজায় থাকতে পারে। ততোদিনে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য নিজেদেরকে আরও অধিকতর যোগ্য করে নেবেন। কিছুটা দেরিতে হলেও একদিন একেবারে আকস্মিকভাবে ইসলামী আন্দোলন ইন শা আল্লাহ সাফল্য লাভ করতে পারবে বলে আশা করি।
তিন.
ইসলামী আন্দোলনের অগ্রগতিতে তৃতীয় যে ব্যাপারটি বেশ ভালো ভূমিকা রেখেছে তা হচ্ছে, কাজের ধারাবাহিকতা, নিয়মতান্ত্রিকতা এবং নেতৃবৃন্দের পেশাদারিত্ব। রাজনীতিতে ধারাবাহিকতা একটি অপরিহার্য বিষয়, এটি তার রুহ, প্রাণ। এটি ছাড়া কাজে উন্নতি-অগ্রগতি বহু দূরের কথা, দলের অস্তিত্বই টিকতে পারে না। আর এজন্য প্রয়োজন পেশাদার নেতৃত্ব। পেশাদারিত্ব বলতে এখানে বাণিজ্য বোঝাইনি; বুঝিয়েছি যারা ফুলটাইম কাজ করবেন, রাজনীতিই হবে যাদের প্রধান কাজ। এজন্য তাকে বিশিষ্ট আলেমশ্রেণির কেউ হতে হবে না, তবে উদ্যমী হতে হবে, তারুণ্যদীপ্ত হতে হবে, তাকে বিচক্ষণ-দূরদর্শী ও সাহসী হতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত নেতৃবৃন্দের এই গুণ-ভূষণ আছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দ্বিতীয় দল যার নেতৃত্ব উপর্যুক্ত যাবতীয় বৈশিষ্ট্যে গুণান্বিত। বরং অনেক ক্ষেত্রে জামায়াতের চেয়েও এগিয়ে রয়েছেন ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ।
সারা দেশে পর্যায়ক্রমিক সফর, দৈনন্দিন রাজনীতিক সভা-ওয়ায মাহফিলে অংশ গ্রহণ করতে নেতৃবৃন্দ যেভাবে পুরো দেশ চষে বেড়ান সেই উদাহরণ অন্যান্য দলে মেলাই ভার। এর ফলে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা বেড়েছে, কেন্দ্র থেকে জেলা-উপজেলা-ইউপি-ওয়ার্ড-ইউনিটে সংগঠন বিস্তৃত হয়েছে। নানা শ্রেণি-পেশার সম্পৃক্ততার দরুণ ছাত্রআন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, যুব আন্দোলন, শিক্ষক ফোরাম, ওলামা-মাশায়েখ পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ ও আইনজীবী পরিষদসহ অনেকগুলো সহযোগী সংগঠনের সৃষ্টি হয়েছে।
এসব সংগঠনের মাধ্যমে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ইসলামের আদর্শ যথাযথভাবে পৌঁছে যাচ্ছে এবং তাঁরা দলের কেন্দ্রীয় মোহনায় এসে সমবেত হচ্ছে। আজকে সারা দেশে ইসলামী আন্দোলনের ব্যাপক বিস্তৃতি, তৃণমূল পর্যায়ে সম্প্রসারিত সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক এবং যে গণভিত্তি তৈরি হয়েছে তা অনেকটাই নেতৃবৃন্দের পেশাদারিত্বের কারণে, দলের ধারাবাহিক কর্মসূচির কারণে এবং নিয়মাতান্ত্রিকতার কারণে।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক
Leave a Reply