প্রশ্ন : ইতিহাস চর্চাটা আসলে কী?
উত্তর : ইতিহাস চর্চা মূলত অতীতকে জানা, বোঝা এবং তা থেকে উপদেশ গ্রহণ। আরবিতে প্রবচন আছে “ কাসাসুল আউওয়ালীনা মাওয়ায়িযুল আখিরীন অর্থাৎ পূর্ববর্তীদের ইতিবৃত্তি পরবর্তীতের জন্য শিক্ষণীয়। অতীত থেকে উপদেশ গ্রহণমূলক যে অনুসন্ধান তাই ইতিহাস চর্চা। এতে করে একটি জাতি-গোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিখুঁত হয়, অকল্যাণ ও ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া থেকে নিরাপদ থাকে।
প্রশ্ন : উর্দুতে, আরবিতে ইতিহাস চর্চা এবং এ দেশে তরুণদের ইতিহাস গবেষণার ফারাক কেমন?
উত্তর : বিশাল ফারাক, পার্থক্যটা মৌলিক-অমৌলিকের। বাংলায় ইসলামি ইতিহাসের অনেকটাই অনুবাদ। মৌলিক, তথ্যনির্ভর, গবেষণাসমৃদ্ধ ও উপদেশমূলক ইতিহাসচর্চা বাংলায় এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। গবেষণা, অনুসন্ধান, শ্রমসাধনা ও অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে ইতিহাস সাহিত্য সৃষ্টির তুলনায় অনুবাদকর্ম বা রূপান্তরের কাজ অনেক সহজ। সে কারণে অনেক লেখকখ্যাতি অর্জনকামী অনুবাদের দিকে ঝুঁকছে। অনুবাদেরও প্রয়োজন আছে, তবে মৌলিক লেখক তৈরি হওয়াও জরুরি।
প্রশ্ন : ইতিহাস চর্চার জন্য কেমন পড়াশোনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন?
উত্তর : সাম্প্রতিককালে আরব-ইরান-তুরানের ইতিহাস বিষয়ে বেশ সমৃদ্ধ অনুবাদ বেরুচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর হিন্দ উপক্ষিত থেকে যাচ্ছে। পাক-ভারত ও বাংলাদেশে ইসলামের ইতিহাসের অবস্থা হয়েছে অনেকটা ‘দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া’র মতো। সারা দুনিয়ার ইতিহাস চর্চিত হচ্ছে, কিন্তু নিজেদেরকেই জানার এবং বোঝার যেন ফুরসতও নেই বা এ অঞ্চলের মুসলমানদের কোনো ইতিহাস নেই অথবা ইসলামের জন্য তাঁদের কোনো অবদান নেই। উপমহাদেশের ইতিহাসের আকর ও উৎসগ্রন্থগুলো রচিত হয়েছে ফারসিতে, সেগুলো আবার প্রায়ই অত্যন্ত সযতেœ ইংরেজিতে অনুবাদিত। আর এই দুই ভাষাতেই আমাদের বিতৃষ্ণার সীমা নেই। উদাহরণস্বরূপ চট্টগ্রামের প্রথম লিখিত ইতিহাসগ্রস্ত হচ্ছে, ‘আহাদীসুল খাওয়ানীন’ ফারসিতে। গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ হয়েছে, কাজটি করেছেন একজন জেনারেল শিক্ষিত ড. খালেদ মাসুকে রসুল। উপমহাদেশীয় মুসলিম ইতিহাসের অন্যতম আকরগ্রন্থ হচ্ছে ‘সিয়ারুল মুতাআখখিরীন’।
কিতাবটি ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় রূপান্তরের জন্য বাংলা একাডেমি থেকে মরহুম আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়াকে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তিনি ইংরেজি থেকে অনুবাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেন, অতঃপর কলকতাস্থ এশিয়াটিক সোসাইটির সংগ্রহ থেকে মূল ফারসি নুসখা ফটোকপি করে এনে অনুবাদের কাজ শুরু করেন। ফারসিতে এ ধরনের বিদ্বান ব্যক্তিত্বের বড়ই অভাব রয়েছে ইসলামি ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে। ফলে উপমহাদেশে ইসলামি শাসন, মুসলিম বিজেতাদের কারনামা ও মুসলমানদের জাতীয় অবদানের চর্চা একেবারে উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : আমাদের ইসলামী পুস্তক বাজারে ইদানীং ইতিহাসের কিছু বই প্রকাশ পাচ্ছে? পাঠক কীভাবে নিচ্ছে?
উত্তর : আমরা জাতি হিসেবে আবেগপ্রবণ ও হুজুগি বললাম না, তবে ঝুঁকি। ইতিহাস পাঠেও সেই জিনিসটা লক্ষ্য করা গেল। ইতিহাসের ক্ষেত্রেই নয়, ইদানীং আরব শায়খদের বিপুল পরিমাণ কিতাবাদি বাংলায় অনুবাদ হচ্ছে। এর শুরুটা হয়েছে আসলে উপমহাদেশের আলেম-পীর-মাশায়েখের এ অঞ্চলে যে প্রভাব তা খর্ব করার জন্য। এসব অনুবাদের দ্বারা উপমহাদেশের ধর্মীয় পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়াকারী দুইটা জিনিসের আমদানি হচ্ছে, আকিদা ও ফিকহ। ফলে উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হচ্ছে, ধর্মীয় দ্ব›দ্ব-বিদ্বেষ ও ইখতিলাফ বৃদ্ধি হচ্ছে। ইতিহাস দিয়ে শুরু করে আরব লেখকদের যাবতীয় রচনা বাছ-বিচার ছাড়াই অনুবাদ করা হচ্ছে, কোন কাজটি এ দেশের ধর্মীয় পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যশীল কোনটা বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে তা বিবেচনা করা হয় না।
প্রশ্ন : ইতিহাস নিয়ে মৌলিক কাজের কেউ সাহস করেন না কেন?
উত্তর : তিনটি কারণে: ভাষাগত অনভিজ্ঞতা, শ্রম-সাধ্য অনুসন্ধানের মানসিকতার অভাব এবং অবাণিজ্যিক সেবাধর্মী পৃষ্ঠপোষকতার শূন্যতা।
প্রশ্ন : এ দেশে হাদিস চর্চা এবং মনীষী চর্চা ঠিকভাবে হচ্ছে বলে মনে করেন কী?
উত্তর : উপমহাদেশে হানাফি মাযহাব প্রচলিত, এটি সারা বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিমের মাযহাব, ইসলামি শাসন ইতিহাসে বেশিরভাগ সময়জুড়ে রাষ্ট্রীয় মাযহাব হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছিল। এর ফলে এ মাযহাব অনেক সমৃদ্ধ। কিন্তু একশ্রেণির মানুষ অভিযোগ করে, হানাফি মাযহাব দলিলনির্ভর নয়। বস্তুত হানাফি মাযহাবের কোনো মাসআলাই দলিলবিহীন নয়। এটা প্রোপাগান্ডাদের অজ্ঞতা এবং মাযহাব অনুসারীদের সঠিকভাবে হাদিসচর্চার ক্ষেত্রে উদাসীনতা।
প্রশ্ন : মনীষীদের নিয়ে যেসব পুস্তক হচ্ছে তাতে কী অভাব দেখতে পাচ্ছেন?
উত্তর : উপমহাদেশের ফারসি ইতিহাসগ্রন্থগুলোর কথা বলেছিলাম। এসব গ্রন্থের একটি দুর্বল দিকও আছে। এসবে রাজা-বাদশাদের যুদ্ধ-বিগ্রহের খবরই বেশিরভাগ বর্ণনা করা হয়েছে। সমসাময়িক ওলামা, পীর-মাশায়েক ও ফকিহদের জীবনচরিত এবং তাঁদের সামাজিক অবদানের কথা চর্চা হয়নি। এ অভাব পূরণে এগিয়ে এসেছিলেন সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.), কিন্তু বাংলায় এই কাজের বড়ই অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। উদাহরণত স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স এখন ৫০, এর আগে পাকিস্তান ও ব্রিটিশ আমল ছিল। তার আগে ছিল হাজার বছর ধরে মুসলিম শাসন। ব্রিটিশ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিদের একটি জীবনী রচনা করা যেতে পারে সহজে। কিন্তু মুসলিম শাসনামলের প্রধান বিচারপতি বা কাযিউল কুযাত যারা ছিলেন তাদের কি কোনো ঐতিহাসিক তথ্য আমাদের কাছে আছে? তাঁরা আলেম ছিলেন, ফকিহ ছিলেন, তাঁদের বিচার বিভিন্ন রায় আছে। শ্রমসাধ্য অনুসন্ধানী ইতিহাস রচনা করলে তাদের জীবনী, রায়ের নমুনা খুঁজে বের করা যাবে।
প্রশ্ন : মনীষা গবেষণায় কী ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি বলে মনে করেন?
উত্তর : অবাণিজ্যিক ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এই কাজটির জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ একট উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান।
প্রশ্ন : সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ
উত্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
Leave a Reply