মাওলানা আমিনুল ইসলাম : আল্লামা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া রহ. আমার প্রিয় উস্তাদ। আমি যত উস্তাদের কাছে পড়েছি, তার মধ্যে তিনি প্রথম সারির। তিনি জামেয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ ঢাকা -এর অন্যতম মুহাদ্দিস ছিলেন। আবুল ফাতাহ সাহেবের ব্যাপারে লিখতে গেলে আমি দ্বিধা- দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। তাঁর কোন সাইড নিয়ে লিখব। যিনি সর্ব সাইডে স্কলার। ক্রিকেটের ভাষায় বলে অলরাউন্ডার। তাঁর কোন দিকে, কোন প্রকার কমতি ছিল না। সুতরাং কোনটা লিখব? সেটা যেন আমি খুঁজে পাই না।
তিনি এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন, সর্ব বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল। প্রচুর লেখা পড়া করতেন। যার কারণে কোন বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের ঘাটতি ছিল বলে মনে হয়নি কখনো।
আবুল ফাতাহ সাহেব যেমন ছিলেন একজন মুহাক্কিক আলেম, আবার তিনি খ্যাতিমান লেখক-গবেষক। বক্তৃতার ময়দানে তিনি ছিলেন বড় একজন বাগ্মী। লিখনীর ময়দানে একজন অবিসংবাদিত কলম সৈনিক। যার কলমের ধার ছিল প্রখর। আবার আবুল ফাতাহ সাহেব ছিলেন একজন খ্যাতিমান উপস্থাপক।
তিনি অল সাইডে পরিপূর্ণ একজন ব্যক্তি। আমার নজরে এরকম চতুর্মুখী যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ খুব কমই মিলেছে।
আসলে আবুল ফাতাহ সাহেব এমন কিছু মানুষের সোহবতে পেয়ে ছিলেন, যার কারণে তিনি নিজেকে অনেক উঁচুতে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তাঁর দুইজন প্রিয় উস্তাদ আল্লামা কাজি মু’তাসিম বিল্লাহ এবং আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, এরকম দুই মহারথির সংস্পর্শে থেকে পুরো জাতির মাঝে জ্যোতি ছড়িয়ে ছিলেন তিনি। যোগ্য ব্যক্তির সোহবত আবুল ফাতাহ সাহেবকে ধন্য করেছিল।
একদম হাতে কলমে উস্তাদদের থেকে শিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। যার কারণে সারা জীবন আপন উস্তাদদের বন্দনায় ছিলেন। দুই উস্তাদের অসম্ভব ভক্ত ছিলেন আবুল ফাতাহ সাহেব। তাইতো, তাঁর কাছে বসলে আল্লামা কাজি মু’তাসিম বিল্লাহ এবং আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদের গুণগান শোনা যেত।
শিক্ষক হিসেবে আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেব ছিলেন বে-মেছাল। তাঁর মত শিক্ষক এই জামানায় বড্ড অভাব। তাঁর জ্ঞানের সীমা যে কোথায় ছিল আল্লাহ মালুম। আমি নিজে বহু কিতাব পড়েছি তাঁর কাছে। পড়ানোর ভঙ্গিমা ছিল চমৎকার।
ক্লাসে সর্বদা হাস্যজ্জল থাকতেন। প্রথমে সাবলীল ভাষায় আগামী দিনের পড়ার বিষয়টা আলোকপাত করতেন, এরপর কিতাবের ইবারতের সাথে সামঞ্জস্য জুড়ে দিতেন। তাঁর অধ্যাপনার নিয়ম নীতি বড় সু্ন্দর ছিল। ক্লাসটা যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। তাঁর লেকচার গুলো এমন ভাবে উপস্থাপন করতেন, যার দ্বারা সব ধরনের ছাত্রদের বোধগম্য হত।
আবুল ফাতাহ সাহেবের দরসের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে ছিল দেশব্যাপী। দেশের সকল মাদ্রাসাগুলোর ছাত্র শিক্ষকের মাঝে তাঁর সুনাম ছিল।
আমি সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এর দরস দেখিনি। শুনেছি সে সেই দরসের প্রশংসা। মাদানী রহ.-এর অধ্যাপনার নিয়ম নীতি এত মজার ছিল, তিনি সারা রাত পড়ালেও কোন ছাত্র বিরক্ত হত না।
মাদানী রহ.-এর ছাত্র ছিলেন, কাজি মু’তাসিম বিল্লাহ রহ. ঠিক মাদানী সাহেবের অধ্যাপনার নিয়ম নীতি আয়ত্বে এনেছিলেন কাজি সাহেব হুজুর। একদম মাদানীর পুরোপুরি পদাঙ্ক অনুসরণ করতেন।
আবার কাজি সাহেবের শাগরেদ হলেন আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ সাহেব। তিনিও কাজি সাহেবকে অনুসরণ করেছেন। ফরীদ উদ্দীন মাসউদ সাহেবের দরসের মাঝে কাজি সাহেব ও মাদানী রহ.- এর গন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়।
ঠিক আবুল ফাতাহ সাহেব ফরীদ উদ্দীন মাসউদ সাহেব এবং কাজি সাহেব হুজুরের প্রিয় ছাত্র ছিল। আবুল ফাতাহ সাহেবের দরসের মাঝে প্রিয় উস্তাদদের সুঘ্রাণ ফুটে উঠত। তিনি যখন দরস দিতেন, তাঁর পুর্বসূরীদের অনুসৃত রীতি অনুযায়ী দিতেন। প্রিয় উস্তাদদের অনুসরণ করতেন সবসময়।
আবুল ফাতাহ সাহেব তাঁর প্রিয় উস্তাদদের অনুস্মরন করে চলার কারণে তিনি অধ্যাপনায় খ্যাতি লাভ করেছিলেন, রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানেরর অধ্যাপক গণ তাঁকে ভক্তির নজরে দেখতেন।
আমি যখন মেশকাত জামাতে পড়ি, সে বছর যশোর শহরের একটা মাদ্রাসায় আমার সাক্ষাত হয়ে ছিল, খুলনা দারুল উলুমের একজন মুহাদ্দিস সাহেবের সাথে, যিনি অত্যন্ত মেধাবী একজন আলেম। তিনি আমার পরিচয় জানলেন, আমি যখন বললাম, ঢাকা মালিবাগ মাদ্রাসার ছাত্র, তিনি যেন পাগলপারা হয়ে গেলেন। তাঁর মুখ দিয়ে শুধু আবুল ফাতাহ সাহেব এর বন্দনা। তিনি বারবার বলতে লাগলেন, আবুল ফাতাহ সাহেবের মত প্রতিভাবান আলেম বর্তমান জামানায় বিরল। তাঁর টিচিং ক্যাপাসিটি, তাঁর লিখনী, তাঁর বক্তৃতা, তাঁর যোগ্যতার কোন তুলনা হয়না।
এরকম সারা বাংলাদেশের আলেমদের মুখে মুখে ছিল আবুল ফাতাহ সাহেবের প্রসংসা। সর্ব বিষয়ে তাঁর যোগ্যতা ছিল।
লিখনীর ময়দানে আবুল ফাতাহ সাহেব ছিলেন এক অবিসংবাদিত কলম সৈনিক। কলমের ধার ছিল সাংঘাতিক। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি নামকরা লেখক। তাঁর লেখা সর্ব মহলে প্রসংসিত ছিল।
যখন তিনি একেবারে নিচের ক্লাশের ছাত্র, সে সময়ে রচনা প্রতিযোগীতা দিয়ে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করে হৈচৈ ফেলে দিয়ে ছিলেন। সারা দেশের মাঝে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল।
একজন প্রতিভাধর লেখক ছিলেন আবুল ফাতাহ সাহেব। তাঁর মত কলমী শক্তি সমকালীন জমানায় পাওয়া দুস্কর ছিল। তাঁর লেখার ভাষা গুলো ছিল চমকপ্রদ। একজন মাদ্রাসায় পড়ুয়া লোকের ভাষা এত উচ্চাঙ্গের কল্পনা করা যায় না।
লিখনীর জগতের এক সম্রাট ছিলেন তিনি। তাঁর প্রবন্ধ, রচনা,গবেষণার ভাবই ছিল আলাদা। তিনি যে সব গবেষনা মুলক বই লিখে গেছেন, তা আমাদের কাছে স্মরনীয় হয়ে আছে।
আমরা যখন ছাত্র, তখন দারুল উলুম দেওবন্দের ঐতিহ্য অবদান সম্পর্কে বাংলা ভাষায় তেমন উল্লেখ যোগ্য গ্রন্হ ছিল না। আবুল ফাতাহ সাহেব আমাদের কে পড়াতেন, তিনি লিখে লিখে পান্ডুলিপি করতেন। তাঁর সেই পান্ডলিপি ” দেওবন্দ আন্দোলন ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান”। যেটা কওমী মাদ্রাসার ফযীলত দ্বিতীয় বর্ষের পাঠ্য।
এমনি ভাবে ইসলামী অর্থনীতির উপর তিনি প্রতিদিন লিখে লিখে প্রবন্ধ তৈরী করে আমাদের পড়াতেন। সেটাও এক পর্যায়ে বড় পান্ডুলিপি হয়ে গেল। সে পান্ডুলিপিটাও এখন ” ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রুপায়ন ” নামে ফযীলত দ্বিতীয় বর্ষের পাঠ্য।
” আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও ইসলাম”, স্রষ্টা ও তাঁর স্বরুপ সন্ধানে”, হাদীস অধ্যায়নের মুলনীতি,ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্হা, এরকম বহু গবেষণা মুলক বই রয়েছে আবুল ফাতাহ সাহেবের। এছাড়া বহু অনুবাদ গ্রন্হ রয়েছে তাঁর। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে বুখারীর শরীফের অনুবাদ ( আংশিক) তিনি করেছেন।
বক্তৃতার ময়দানে এক বড় বাগ্মী ছিলেন তিনি। তাঁর বহু বক্তৃতা আমি শুনেছি । প্রায় জুময়ার দিন আবুল ফাতাহ সাহেবের মসজিদে জুময়ার নামাজ আদায় করতাম। অত্যান্ত প্রান্জল ভাষায় বয়ান দিতেন তিনি। তাঁর বয়ান শোনার জন্য মানুষ উম্মুখ হয়ে থাকত।
আবুল ফাাতাহ সাহেবের তাফসীর ছিল বড় মজার। অনেক মুতালায়া করে তাফসীরে বসতেন। পুরো মজলিস জমিয়ে রাখতেন তিনি। তাঁর জ্ঞান – গর্ভ আলোচনায় স্রোতারা মুগ্ধ হয়ে যেত।
উপস্হাপক হিসেবে আবুল ফাতাহ সাহেবের বিশাল সুনাম- সুখ্যাতি ছিল। তাঁর মত উপস্হাপক ঐ জমানার মধ্যে ছিল না বলা যায়। আলেম – উলামার বড় বড় অনুষ্ঠানে আবুল ফাতাহ সাহেব উপস্হাপক থাকতেন।
তিনি যেখানেই উপস্হাপক থাকতেন, সে মজলিসে তাক লেগে যেত। অনেক মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত তাঁর দিকে।
একবার মালিবাগ জামিয়ার এক অনুষ্ঠানে আবুল ফাতাহ সাহেবের উপস্হাপনা দেখে ঢাকা সুপ্রিম কোর্টের একজন আইন জীবি অবাক হয়ে আমাকে বলে ছিলেন, তিনি কে? একজন আলেমের এত সুন্দর উপস্হাপনা!! সত্যি প্রসংসনীয়।
মোটকথা, আবুল ফাতাহ ইয়াহইয়া সাহেব এক সুযোগ্য আলেম ছিলেন। তিনি জীবনটা সাজিয়ে ছিলেন প্রিয় উস্তাদদের সোহবতের মধ্য দিয়ে।
বর্তমানে অনেকে অনেক কথা বলছেন, কেউ তাঁকে নিয়ে ট্রল করছেন। আসলে তিনি ছিলেন প্রিয় উস্তাদ আল্লামা মাসউদ এর পদাঙ্গ অনুসারী। একদম উস্তাদের ফটোকপি ছিলেন। আমৃত্যু হক- হক্কানিয়্যতের উপর অটল- অবিচল।
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসে সমাসিন করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক
Leave a Reply